১৬ জুন ২০২৪, রবিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

পিতা

নুসরাত সুলতানা || ১০ মে, ২০২৩, ০২:০৫ পিএম
পিতা


রহমতের সঙ্গে কথা শেষ হতেই আফজাল সাহেবের রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে সব ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠো করে আফজাল সাহেব বলেন,  স্কাউন্ডেল, শুয়োরের বাচ্চাটাকে পেলে আমি গলা টিপে মেরে ফেলতাম।

আফজাল সাহেবের একমাত্র মেয়ে টুম্পা তিনদিন আগে কানাডা থেকে ফোন করে জানায়, ছেলে স্বপ্নীলের ভয়াবহ অসুস্থতার কথা। সেই থেকেই আফজাল সাহেব ও তার স্ত্রী চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। একমাত্র নাতির মরণব্যাধি। কী করে এমন হতে পারে!  সবসময়ই তো তারা মিনারেল ওয়াটার খাইয়েছে নাতিকে।

 আফজাল সাহেবের চোখে ভেসে ওঠে বিকেল ৫ টায় বেশ খোশ মেজাজে বসেছিলেন তিনি। সময়টা শরৎকাল। ড্রাইভার  রহমত দৌড়ে অফিসে ঢুকেই  তার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, বড়সাব আমারে ছুটি দেন। আমার ছেলেডা খুউব অসুস্থ!  আজ তিন দিন ধইরা কিছু খায় না।

আফজাল সাহেব  নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলেন, কী হয়েছে তোর ছেলের? আজ আমার একমাত্র মেয়ে টুম্পা নানাভাইকে নিয়ে দেশে আসবে। মাস দুয়েক থাকবে। ওদের আনতে বিমানবন্দরে যেতে হবে। এই নে দুহাজার টাকা। তুই বাড়িতে পাঠিয়ে দে। দুই দিন পরে যাইস বাড়িতে। যা বিকাশ করে আয়। আমি তোকে নিয়ে বের হবো।

রহমত টাকা বিকাশ করতে বের হয়ে যায়। রহমতের বাড়ি বেনাপোলে।  ড্রাইভার হলেও ছেলেকে নিয়ে রহমতের অনেক স্বপ্ন। বউকে সবসময়ই বলেছে ছেলেকে দুধ-ডিম-কলা খাওয়াতে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া ছেলেকে রেখে দিয়েছে হোম টিউটর। রহমত বউকে টাকা বিকাশ করে বলে, মাসুমরে সদরে নিয়া ডাক্তার দেখাও আমি দুই দিন পর আইতাছি । আইয়া মাসুমরে বড় ডাক্তার সাবের ধারে লইয়া যামু।

কোনো চিন্তা কইরো না মাসুমের মা। আল্লহরে ডাকো।

গরিবের আল্লাহ ছাড়া আছে কেডা! ফোনের অন্য প্রান্তে নিঃশব্দ চোখের পানি ফেলে মাছুমের মা।

 হেই রাত্তিরে পোলার কবরে হারা রাইত বইয়া থাইক্কা পতিজ্ঞা করছিলাম আমি খুনের পতিশোদ নিমু। আপনে আমার পোলাডারে খুন করছেন। তাই আমি আপনের নাতির পানিতে আর্সেনিক মিশাইয়া দিছি। বোঝেন একটু হারানোর ব্যাতা কী!  

আফজাল সাহেবকে  আল্লাহ সুখ শান্তি ধন দৌলত সবই দিয়েছেন। সেদিন একমাত্র মেয়ে আসবে কানাডা থেকে তার নাতিকে নিয়ে। আর একমাত্র ছেলে টিপু আমেরিকায় হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.বি. এ পড়ছে। ফিরে এসে তার পাঁচ পাঁচটা ইন্ডাস্ট্রির হাল ধরবে, এটাই তার একান্ত  প্রত্যাশা। 

রহমতকে নিয়ে আফজাল সাহেব বের হয়ে যান বিমানবন্দরে। ওই তো তার নানাভাই স্বপ্নীল।  মাশাল্লাহ নানাভাই বেশ  নাদুসনুদুস হয়েছে। চোখগুলো কী ঢলঢলে নাতিটার! আফজাল সাহেবের চোখে দ্যুতি খেলে যায়। মেয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে।  বলে, ড্যাড তোমার ভুড়ি এত বেড়ে গেছে! আফজাল সাহেব মেয়েকে বুকে নিয়ে সাতরাজ্যের আদর দেন। স্বপ্নীল বলে, হেই ওল্ডম্যান হাউ  আর ইউ? আফজাল  সাহেব অমনি দরাজ গলায় হা আ হা আ হা আ করে হেসে ওঠেন।

সবাইকে নিয়ে  আফজাল সাহেব গুলশানের বাসায় এলেন। তার বাসায়  চাঁদের হাট বসেছে। স্বপ্নীলকে কী খাওয়ালে হয়! সারাক্ষণ ব্যস্ত রাহেলা বেগম। আর রহমত ব্যস্ত বাজার করা নিয়ে। সারাদিনই ফল, মাছ, ফাস্টফুড, ড্রিংক এসব নিয়ে রহমতের ছোটাছুটি।

রহমতের ছুটি আরও দুই দিন পিছিয়ে গেলো।  সারাক্ষণ রহমত প্রহর গোনে এই বুঝি বড়সাব ছুটি দেন। রহমতের কলিজায় পানি নেই। ছেলে মাসুমের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এদিকে বড়সাবের অমতে যেতেও পারছে না। চাকরি চলে গেলে বউ, বাচ্চা আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে সে খাবে কী?

ছেলেকে মানুষ করবে কী করে!  অগত্যা রাহেলা বেগমের হাতে-পায়ে ধরে  কান্নাকাটি করে ছুটি আদায় করে রহমত।

পাঁচদিন পরে রহমত হাজির হয় অসুস্থ ছেলের সামনে। ছেলে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। চোখ মুদেই বলে, বাবা আমার  গাড়ি আনছ? রহমত বলে, বাবা আমি দুন্নাই একলগে আইন্না দিমু ,তুমি আগে সুস্থ অও।

আংগুরি অন্য দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে। বকে চলে রহমতের মা, তুই কেমন বাপ?

চাকরি ছাইড়ড়া ক্যান চইল্লা আইলি না?  দিনমজুরি কইরা খাইতি!

কিছুদিন পর ফিরে আসে রহমত। সঙ্গে অনেক উপঢৌকন।  গ্রাম থেকে ডাব,কলা,দেশি মুরগির ডিম নারকেল, ডালের বড়ি। আফজাল সাহেব খুব খুশি। আহ্লাদী কণ্ঠে বলে, কী রে এতকিছু কেন এনেছিস! নানাভাইয়ের জন্য? নে তোকে একহাজার টাকা বকশিস দিলাম। রহমত শুকনো হাসি দেয়। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। বলে, লাগবে না স্যার। আপনের নাতি তো আমারও পরম আত্মীয়। 

আফজাল সাহেব রহমতের ছেলের খোঁজ খবর নেন। রহমত বলে সে অনেকটা সুস্থ। চিকিৎসা চলছে। 

রহমত সোৎসাহে আফজাল সাহেবের বাসায় বাজারসওদা করতে থাকে। একদিন স্বপ্নীলের জন্য মিনারেল পানি আনতে পাঠায় আফাল সাহেব। রহমত ১০ লিটারের বোতল নিয়ে আসে। কিন্তু বোতলের মুখ খোলা। রাহেলা বেগম জিজ্ঞেস করলে বলে, স্বপ্নীল ভাইজানকে নিচে পানি দিয়া আইছি।

প্রায় দুই মাস  শেষ করে টুম্পার ফিরে যায় কানাডা। বাবা-মা চোখের জলে বিদায় দেয় মেয়েকে। ফেরার সময় রাহেলা বেগমের চোখের জল বাঁধ মানে না। আফজাল সাহেব বারবার নাতিকে চুমু খান। বলেন, ওল্ডম্যানকে দেখতে আবার এসো নানাভাই! ওল্ডম্যান  অলওয়েজ উড বি ওয়েটিং ফর ইউ।

কানাডা গিয়ে  হঠাৎ করেই অসুস্থ  হয়ে পড়ে স্বপ্নীল। তার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। ডাক্তার বলে, স্বপ্নীলের রক্তে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।  টুম্পা চোখে অন্ধকার।  ফোনে বাবাকে সব জানায়। আফজাল সাহেব কোনো কূলকিনারা খুঁজে পান না। পান না রাহেলা বেগমও। সবসময় স্বপ্নীলকে মিনারেল ওয়াটার খাওয়ানো হয়েছে। 

রহমত মায়ের অসুস্থতার কথা বলে বাড়ি গেছে।  এরপর ছয়দিনের মাথায় রহমতের ফোন আসে, স্যার কেমন আছেন?  আফজাল বিমর্ষ চেহারায়, ভেঙে যাওয়া ফ্যাসফ্যাসে  কণ্ঠস্বর নিয়ে বলে, ভালো নেই রহমত। আমার দাদু ভাইয়ের খুউব অসুখ! তুই তো সবসময় মিনারেল পানি এনেছিস! রহমত নিষ্ঠুর হাসি হাসে আর বলে, স্যার আপনার বাসায় বাজার করার জন্য আমার ছেলের কাছে আসতে দেন নাই। মারা গেছে আমার ছেলেটা।  হেই রাত্তিরে পোলার কবরে হারা রাইত বইয়া থাইক্কা পতিজ্ঞা করছিলাম আমি খুনের পতিশোদ নিমু। আপনে আমার পোলাডারে খুন করছেন। তাই আমি আপনের নাতির পানিতে আর্সেনিক মিশাইয়া দিছি। বোঝেন একটু হারানোর ব্যাতা কী!  

আফজাল সাহেবের মাথায় আর কিছুই ঢোকে না। তিনি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। আর তখনই মনে হয় তার কানে ঠা-ঠা করে অনবরত বেজে চলেছে রহমতের অট্টহাসি। 



আরো পড়ুন