কৃষিভাণ্ডার খ্যাত উত্তরের জেলা গাইবান্ধা। এখানকার অধিকাংশ পরিবার কৃষির ওপর নির্ভরশীল। চলতি বছর জেলায় বোরো মৌসুমের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। তবে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বোরো চাষ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। চাষিরা জানান, খরচ জোগাতে অনেকেই ঋণের ফাঁদে পড়ছেন। সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছেন দরিদ্র ও বর্গা কৃষকরা। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, খরচ কিছুটা বাড়বে, তবে লোকসান হবে না চাষিদের।
গত বছরের তুলনায় এবার জেলার বোরো আবাদে প্রায় ১৯২ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে বাড়তি খরচ হতে পারে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা বোরোর চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আবার কেউ কেউ সার প্রয়োগ ও ক্ষেত পরিচর্যা করছেন। অন্য বছরের এই সময়ে কৃষকদের মুখে হাসি দেখা গেলেও এবার দুশ্চিন্তা করছেন।
কৃষকরা জানান, সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, সার-কীটনাশক ও শ্রমিকসহ অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বোরো আবাদের খরচ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। বীজতলা তৈরি ও চারা রোপণের জন্য পাওয়ার টিলারের মাধ্যমে জমি চাষ দিতে হয়। ডিজেলের দাম বেড়েছে লিটারে প্রায় ৪২.৫ শতাংশ। ফলে পাওয়ার টিলারের খরচ বেড়ে গেছে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ে যন্ত্রে ডিজেল বা পেট্রোলের ব্যবহার হয়, সেখানে গুনতে হবে বাড়তি খরচ। চলতি বোরো মৌসুম থেকেই বাড়তি এ বোঝা টানতে হবে তাদের।
গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বোরো মৌসুমে ১ লাখ ২৭ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। এ বছর ১ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যার এ পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ৮৫ ভাগ। লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া ওইসব কৃষকের জমিতে সেচ দিতে বিদ্যুৎচালিত গভীর সেচযন্ত্র ২৩৯টি, অগভীর ৩ হাজার ৫০টি, ডিজেল চালিত অগভীর ২ হাজার ৯৩২টি, এলএলপি বিদ্যুৎ ১৭ ও সোলার সেচযন্ত্র রয়েছে ৩৩টি। এসব যন্ত্র দিয়ে বোরো চাষিদের সেচের চাহিদা মেটানো হবে।
স্থানীয় কৃষক জহির উদ্দিন জানান, গত বোরো মৌসুমে ১ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করছিলেন। এতে তার সর্বমোট খরচ হয়েছিল ৮২ হাজার ৫০০ টাকা। এ বছর তা হেক্টর প্রতি ৯৭ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হতে পারে। ফলে চলতি মৌসুমে বোরো ধান চাষের বাড়তি খরচ নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। গত বছরে বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র মালিককে হেক্টর প্রতি ভাড়া দিয়েছিলেন ১২ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু এ বছর বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেটি মেশিন মালিক ১৭ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করেছে।
তিনি বলেন, ‘শুধু বিদ্যুতের দামই নয়, সম্প্রতি বীজ, সার-কীটনাশক শ্রমিকের দামও বেড়েছে অনেক। সবমিলে এ বছর হেক্টর প্রতি অতিরিক্ত প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। আবার প্রাকৃতি দুর্যোগের প্রভাব পড়লে তো পথে বসা ছাড়া উপায় নেই।’
গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার পুঠিমারি গ্রামের ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ প্রাপ্ত কৃষক আমির হোসেন বলেন, ‘আগের মৌসুমে কেনা ৬৬ টাকার ডিজেল বর্তমানে কিনতে হচ্ছে ১১২ টাকা পাইকারী দরে। আবহাওয়ার কারণে ১ বিঘা ধানের জমিতে সেচ দিতে কখনো ৩২ লিটার কখনো ৪৫-৫০ লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়। দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে উৎপাদনে। সে তুলনায় আমরা লাভবান হচ্ছি না।’
বিদ্যুৎ চালিত অগভীর সেচযন্ত্রের মালিক জামাত আলী বলেন, ‘গত বোরো মৌসুমে গৃহস্থদের কাছ থেকে বিঘা প্রতি ১ হাজার ৬৫০ টাকা নেওয়া হয়েছে। এ বছরের বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২ হাজার ৩১০ টাকা নির্ধারণ করেছি। কিন্তু এখনও বিদ্যুতের নতুন বিল হাতে পাওয়া যায়নি।’
কৃষি বিভাগের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তানজিমুল হাসান বলেন, ‘সম্প্রতি বৈশ্বিক সমস্যার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে দাম কিছুটা বেড়েছে। যার প্রভাব কৃষি ক্ষেত্রেও পড়বে। সেচ কাজে কৃষকের কিছুটা খরচ বাড়বে। তবে তাদের লোকসান হবে না। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে ফলন বাড়াতে এবং খরচ কমাতে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বোরো চাষে কৃষকদের লাভবান করতে ইতোমধ্যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কিছু কিছু জায়গায় সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কৃষকরা বোরো ধান ঘরে তুলে লাভবান হবেন।’
ঢাকা বিজনেস/এম