‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’-এই প্রবাদ বাক্য সবাই জানি। মায়ের গর্ভে থাকা আজকের শিশু পরবর্তী সময়ে দেশের কর্ণধার হয়ে উঠবে। তাই মাতৃগর্ভে শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত অবশ্য কর্তব্য। আর সন্তান জন্মদান প্রতিটি নারীর স্বপ্ন। সুস্থ সন্তান জন্মদানে গর্ভাবস্থায় নারীর যত্ন অতীব জরুরি।
প্রাক-গর্ভপরিকল্পনার বিষয়ে আমাদের দেশের দম্পতিরা একদম সচেতন নন। অর্থাৎ, সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে অনাগত সন্তানকে স্বাগত জানায় না। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের সংখ্যাই বেশি। আর এজন্যই গর্ভধারণে নারী সম্মুখীন হন নানা শারীরিক সমস্যায়। উন্নত বিশ্বে বিবাহিত দম্পতি সন্তান ধারণের পূর্ব-পরিকল্পনা করলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভবতী হয়। তাই, এসব ক্ষেত্রে নারীর স্বাস্থ্য সন্তান ধারণের উপযুক্ত নাও থাকতে পারে।
গর্ভবতী মায়ের প্রতি যত্নের কমতি রাখা যায় না। কারণ, একজন গর্ভবতী মা তার সন্তানকে ধারণ করেন। আর সন্তানের সঙ্গে মা বাঁধা। মা ও সুস্থ সন্তানের জন্য গর্ভবতী মায়ের দরকার বাড়তি যত্ন।
গর্ভাবস্থায় করণীয়
ডাক্তার দেখানো
গর্ভাবস্থার ১০ মাসে গর্ভবতী মায়েদের ১৪ বার চেকআপ করার কথা থাকলেও আমাদের দেশে অন্তত ৪ বার চেকআপ বাধ্যতামূলক। গর্ভধারণের শুরু থেকে প্রসব পর্যন্ত মোট ৪ বার সেবা নিশ্চিত করা হয়। ৪র্থ মাসের মধ্যে প্রথমবার, ৬ষ্ঠ মাসে দ্বিতীয়বার, ৮ম মাসে তৃতীয়বার, ৯ম মাসে চতুর্থবার সেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। ৫-৮ মাসের মধ্যে গর্ভবতী নারীকে ২টি টিটি টিকা নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় খাবার
আমাদের দেশে গর্ভাবস্থা নিয়ে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত আছে। ‘গর্ভাবস্থায় খাবার কম খেতে হয়, নাহলে শিশু বড় হয়ে যায় আর স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব হয় না’-এটি ভুল ধারণা। গর্ভবস্থায় একজন নারীর সুষম খাদ্য বেশি জরুরি। প্রতিদিনের খাবারে যেনো পরিমিত পরিমাণে আমিষ, শর্করা, ভিটামিন ও অন্যান্য উপাদান থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। শিশু বেড়ে উঠার জন্য আমিষ জাতীয় খাবার যেমন মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, দুধ বেশি করে খেতে হবে। এছাড়া সবুজ ও রঙিন শাক সবজি, তরকারি ও ফল ছাড়াও যেসব খাবারে আয়রণ বেশি আছে, যেমন কাঁচাকলা, পালংশাক, কচু, কচুশাক, কলিজা ইত্যাদি প্রতিদিন নিয়ম করে খেতে হবে। এছাড়া, পরিমাণ মতো পানি পান করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, রান্নায় যেন আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করা হয়।
ব্যায়াম ও স্বাস্থ্য
গর্ভাবস্থায় একটু ব্যায়াম করা জরুরি। তবে প্রাত্যহিক জীবনের ব্যায়াম নয়। একটু হাঁটাচলা করতে হবে। গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন নিতে হবে। কারণ, এই সময় দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, ব্যথাসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
মানসিক যত্ন
গর্ভবতী মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। গর্ভাবস্থায় মুড সুয়িং হওয়া স্বাভাবিক। তাই মনের দিকে একটু বেশিই নজর দিতে হবে। সব সময় পরিষ্কার কাপড় পরিধান করতে হবে। সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকলে মন ভালো থাকে। গর্ভাবস্থায় মন ভালো রাখা ও সবসময় হাসিখুশি থাকা উচিত। দিনে ১-২ ঘণ্টা বিশ্রাম ও রাতে অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুমানো জরুরি।
গর্ভাবস্থায় বর্জনীয়
গর্ভাবস্থায় ভারী কাজ যেমন, টিউবয়েল চেপে পানি আনা, ভারি ব্যায়াম, অতিরিক্ত ভারের কিছু বহন করা, এই কাজগুলো নিষিদ্ধ। এই সময় কাঁচা দুধ-ডিম, কাঁচা বা আধাসেদ্ধ মাংস, কাঁচা পেপে খাওয়া উচিত নয়। গর্ভাবস্থায় নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা একবারেই বাদ দিতে হবে। আর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে একটু বিশেষ যত্ন নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই বাড়িতে দাইয়ের হাতে বাচ্চা প্রসব করা যাবে না।
অনেকসময় গর্ভাবস্থায় রক্তস্রাব হতে পারে, মাথাব্যথা করতে পারে। কখনো কখনো চোখে ঝাপসা দেখতে পারে গর্ভবতী মা। গর্ভাবস্থায় যেকোনো সময় খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। আবার প্রসবের সময় বা প্রসবের পরও খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। কখনো কখনো ভীষণ জ্বর হতে পারে। প্রসবের নির্দিষ্ট তারিখ পেরিয়ে গেলেও প্রসব বেদনা না হওয়া ও নির্দিষ্ট তারিখের আগে প্রসব বেদনা হওয়া ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এর যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে গর্ভবতী মাকে জরুরি সেবার জন্য দ্রুত হাসপাতালে বা নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
গর্ভাবস্থায় যেসব ওষুধ সেবনে সতর্ক থাকা জরুরি
গর্ভাবস্থায় নারীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এসময় একটু অসুস্থতাও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অসুস্থতায় ওষুধ সেবন জরুরি। তবে কিছু ওষুধ গর্ভের সন্তানের জন্য হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক।
আইবুপ্রোফেন
জ্বর সারাতে সেবন করা হয় এই ওষুধ। তবে সুস্থ অবস্থায় এই ওষুধ নিরাপদ হলেও গর্ভবতী নারীর জন্য এই ওষুধ নিরাপদ নয়। গর্ভবস্থায় এই ওষুধ নিয়মিত সেবন করলে প্রজনন ক্ষমতা কমতে থাকে। এছাড়াও গর্ভের সন্তানের হৃদযন্ত্র ও রক্তনালীর ক্ষতি করে এই ওষুধ।
অ্যাসপিরিন
জ্বর-ঠাণ্ডা ও ব্যথার ওষুধ হিসেবে ‘অ্যাসপিরিন’ বহুল ব্যবহৃত। তবে বিশেষজ্ঞদের দাবি, গর্ভধারণের প্রথম কয়েক সপ্তাহে এই ওষুধ সেবনে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে।
লিথিয়াম পিল
হতাশাগ্রস্ততা, মানসিক অস্বস্তি, ‘বাইপোলার ডিজঅর্ডার’য়ের চিকিৎসায় ব্যবহার হয় ‘লিথিয়াম পিলস’। এই ওষুধও গর্ভের সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও দেখা দিতে পারে বিকলাঙ্গতা ও গর্ভকালীন নানান সমস্যা। তাই, গর্ভাবস্থায় এই ওষুধ বর্জনীয়।
লোরাজেপাম ও ক্লোনাজেপাম
‘অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি মেডিকেশন’য়ের তালিকায় এই দুই ধরনের ওষুধের দেখা মেলে। এই ধরনের ওষুধের রাসায়নিক গঠনের কারণে তা গর্ভের সন্তানের মাঝে ‘উইড্রয়াল সিম্পটোম’ নামক সমস্যা তৈরি করে। যাদের এই ওষুধগুলো নিয়মিত খেতে হয় তাদের উচিত চিকিৎসকের সঙ্গে নিজের গর্ভাবস্থা নিয়ে আলোচনা করা।
গুয়াইফেনাসেন
গর্ভবতী নারী সর্দিজ্বরে খুব সহজে আক্রান্ত হন। জ্বর, সর্দি, কাশির ওষুধের একটি সাধারণ উপাদান ‘গুয়াইফেনাসেন’ যা গর্ভের সন্তানের মাঝে বিভিন্ন জন্মগত সমস্যা তৈরি করতে পারে।
মলম, ক্রিম ও স্টেরয়েড ধরনের ওষুধ
শরীরের বিভিন্ন অংশে র্যাশ, ফোলাভাব, অ্যালার্জি ইত্যাদি সবই গর্ভাবস্থার সাধারণ সমস্যা। আর সবগুলোর জন্যই ওষুধের প্রয়োজন। সব ধরনের মলম, ক্রিম, লোশন যা ত্বকের বাহ্যিক অংশে ব্যবহার করা হয় তার সবই গর্ভাবস্থায় নিরাপদ। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মাফিক ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
গর্ভাবস্থায় সহবাস
গর্ভধারণের প্রথম ৩ মাস ও শেষ ৩ মাস সহবাস করলে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হতে পারে এমন আশঙ্কা করে থাকেন। তবে ধারণাটি সঠিক নয়। আপনার গর্ভাবস্থা যদি স্বাভাবিক হয় এবং যদি নির্দিষ্ট কোন স্বাস্থ্য জটিলতার জন্য ডাক্তার আপনাকে সহবাস থেকে বিরত থাকার পরামর্শ না দিয়ে থাকে, তাহলে আপনার জন্য গর্ভাবস্থায় সহবাস করা সম্পূর্ণ নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত। এতে গর্ভের সন্তানের কোন ধরনের আঘাত পাওয়ার বা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ, শারীরিক জটিলতা না থাকলে সহবাসে নিষেধ নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে,গর্ভের সন্তানের যেন ক্ষতি না হয়।
গর্ভবতী মায়ের বিশেষ যত্ন নেয়ার পাশাপাশি সঠিক পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় মা যদি মানসিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়, তাহলে গর্ভজাত সন্তানের মানসিক ও শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থাকে প্রবল। তাই সুস্থ-সুন্দর ভবিষ্যতপ্রজন্ম গড়ার লক্ষ্যে গর্ভবতী মায়ের বিশেষ যত্ন নেওয়া জরুরি। এক কথায় বলা যায়, গর্ভাবস্থায় সঠিক পরিকল্পনা ও যত্ন একে অন্যের পরিপূরক।
ঢাকা বিজনেস/এন