০৪ মে ২০২৪, শনিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

আত্মনিয়ন্ত্রণ: পুরুষ বনাম নারী

এইচ বি রিতা || ১০ এপ্রিল, ২০২৪, ১২:০৪ পিএম
আত্মনিয়ন্ত্রণ: পুরুষ বনাম নারী


আমরা বিশ্বাস করি, বিশ্বের বেশিরভাগ সমস্যা পুরুষদের হাতে ঘটে। বেশিরভাগ সহিংসতা, অপরাধ, খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, যুদ্ধ, অপব্যবহার, ধর্ষণ; সবই পুরুষের। বেশিরভাগ রাজনৈতিক, করপোরেট, সামাজিক ও আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী পুরুষরাই। কুকুররা খুব উপলব্ধিশীল। তারাও হয়তো বুঝতে পারে যে মানব পুরুষরা ভয়ানক। তাই তারা নারীদের চেয়ে পুরুষদের বেশি ভয় পায়। এটি অনেক প্রাণীর ক্ষেত্রেও সত্য; তারা নারীদের ভয় পায় না বলে মনে করা হয়। তবে তারা পুরুষদের ভয় পায়, কারণ তারা পর্যবেক্ষণ করে। তারা অনুভব করে যে পুরুষরা বিপজ্জনক, ধ্বংসাত্মক এবং তাদের মধ্যে সংবেদনশীলতার অভাব রয়েছে। বলা যায়, পুরুষরা মহাবিশ্বের এক ধরনের বিভ্রান্তিকর পরীক্ষায় রয়ে গেছে; কোনো না কোনোভাবে তারা কারণে-অকারণে মন্দের ধ্বংসাত্মক বিশৃঙ্খল শক্তিতে পরিণত হয়েছে। 

যাইহোক, পুরুষ কিন্তু শুধু ক্ষমতা, শক্তি আর অপব্যবহার নিয়েই পৃথিবীতে রাজত্ব করছে না। নারীর মতো পুরুষেরও এমন বহু বহুগুণ রয়েছে; যা নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার। নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে যেমন আমরা পুরুষদের নিন্দা জানাই, তেমনি তাদের ইতিবাচক দিকগুলোর জন্যও তারা প্রশংসার দাবিদার। 

পুরুষের ‘সেল্ফ কনট্রোল’ আব আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অনেক বেশি, যা আমাদের নেই। হয়তো ০.১ শতাংশ থাকতে পারে। একটা সিম্পল উদাহরণ দেই, পুরুষ তার প্রিয় সন্তানের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ম মতো কবর দিয়ে আসতে পারে, সঠিক উচ্চারণে দোয়াটুকু পড়ে ঘরে ফিরতে পারে। পরেরদিন ঠিকই সংসারের কাজে মাঠে নামতে পারে। নারীকে যদি এই কাজটা করতে দেওয়া হয়, তবে দোয়া তো দূরের কথা, বহু নারী সন্তানের সঙ্গে নিজেকেই কবরে  শুইয়ে দেবে চিৎকার করতে করতে।  

এখানেই আসে সেল্ফ কনট্রোলিং বা আত্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। বলা হয় পুরুষের আবেগ কম। বিষয়টা তা নয়। পুরুষের আবেগ নারীর মতোই। পার্থক্য হলো নারী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পাারে না, পুরুষ সবসময় আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এজন্য তাদের কখনো কখনো গণ্ডারের মতোও মনে হয়। আসলে তারা আবেগহীন নয়, তারা ‘সেল্ফ কনট্রোলিংয়ের’ শক্তিশালী উদাহরণ।

আমরা পুরুষদের খুব সহজে বিচার করি এবং তাদের কার্যক্রম নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তে উপনিত হই। কোনো পুরুষ যখন একটু বেশি কথা বলে, নারীদের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে, নিজ থেকে কোনো নারীকে হাই বলে, কিংবা একটু মুগ্ধতা নিয়ে নারীর দিকে তাকায়, হাসে; তখন আমরা অনেকেই সেই পুরুষটাকে 'লুইচ্চা, লুস ক্যারেক্টার, সস্তা, ফালতু কিংবা ব্যক্তিত্বহীন বলে ধরে নেই। অথচ এই একই কাজ আমরাও করছি। আমরা কারণে-অকারণে হাসছি, পকপক করছি, দুর্নাম ছড়াচ্ছি, ছেলেদের সঙ্গে মিশছি, সুদর্শন কারও দিকে তাকাচ্ছি। কোনো পুরুষের গঠন বা ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়নি, এমন নারীর সংখ্যা খুব কমই আছে। পার্থক্য হলো: নারীরা তা প্রকাশ করি না। পুরুষ প্রকাশ করে নানা আকারে-ইঙ্গিতে। 

পুরুষকে কম কথা বলতে হবে, কম হাসতে হবে, ভাব ধরে থাকতে হবে, এমন সব নিয়ম আমাদেরই তৈরি করা। তারা কিন্তু আমাদের অল্প সৌন্দর্য বা সামান্য বিনয়মূলক আচরণে বা হাসিতেই মুগ্ধ হয়। তারা কথা বলে আমাদের সৌন্দর্য নিয়ে। আমাদের ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র নিয়ে খুব কম পুরুষই ফিসফিস করে। 

যাই হোক, পুরুষদের মন্দ দিকটাই আমরা বলি বেশি। আমরা জানি, নারীর তুলনায় পুরুষের সহিংসতা, অপরাধ বেশি। কিন্তু পুরুষে পুরুষে তুলনা করলে, পৃথিবীতে এখনো উন্নত মননশীলতার পুরুষের সংখ্যাই বেশি। আর তাই পৃথিবীতে এখনো ঠিকঠাক সবকিছু উৎপাদন করে যাচ্ছে। চলুন, আজ তাদের ভালো কিছু দিক বা গুণের কথা শুনি। 

১. পুরুষ দ্রুত পরিস্থিতি বদলাতে পারে। তারা হাস্যরসে ভালো জ্ঞান রাখে। কোনো একঘেয়ে বিষয়কে চাইলে মজার করে তুলতে পারে। আবার কখনো কখনো তারা একটি  হাসি দিয়ে জটিল তর্কটি শেষ করে দিতে পারে। 

২. পুরুষরা যত্নশীল এবং সহায়ক হয়। পরিবার রক্ষার জন্য তারা সম্ভাব্য সব উপায় ব্যবহার করে। চাকরি, ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি সবই করে তারা উপার্জনের জন্য। এই উপার্জন দিয়েই তারা পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করে।

৩. তারা নারীদের মতো পেছনে ফিরে দুশ্চিন্তা করে না। অতিরিক্ত চিন্তা করে না। তারা  নারীদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে বিভ্রান্ত হয় না। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তারা চুজি এবং বেশিরভাগ সময় ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করে। তাই পারিবারিক-সামাজিক সিদ্ধান্তে নারীরাও অনেক সময় তাদের অভিমতের ওপর নির্ভর করে। 

৪. তারা দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষোভ ধরে রাখে না। কেউ আঘাত করলে বা অবজ্ঞা করলে 'লেট গো' বলে চলে যায়। আড়ালে দলবেঁধে সমালোচনা করে সময় ও শক্তি নষ্ট করে না। সময়কে বেশিরভাগ পুরুষ কার্যকরী উপায়ে ব্যবহার করতে পছন্দ করে। 

৫. কখনো তাদের কান্নার জন্যও কারও কাঁধের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তারা তখন চেহারায় রুক্ষ্মতা টানে। তারা আবেগ লুকিয়ে রাখে, নিয়ন্ত্রণ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা নিজের সমস্যা বা কষ্টে অন্যকে জড়ায় না। 

৬. তারা মেয়েদের মতো বন্ধুদের প্রতি ঈর্ষা বোধ করে না। 

৭. পুরুষরা শুধু নারীদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের পেছনে ছোটে না। মুখের সৌন্দর্যের  চেয়ে মেয়েদের বুদ্ধিমত্তা এবং পরিপক্বতা পছন্দ করে। 

৮. পুরুষরা পরিবারে মানসিক চাপে থাকলেও সেটা প্রকাশ করে না অন্যের কাছে। এটা তাদের ইগোতে লাগে। 

৯. পুরুষরা আবেগের চেয়ে যৌক্তিক এবং বিস্তৃত ভাবনার হয়। নারীরা যখন ঘটে যাওয়া ছোট ছোট ঘটনাগুলোতে আবেগী ভাবনায় বিচলিত হয়, পুরুষরা তখন ক্যারিয়ার, পরিবারের দায়িত্ব বা আসন্ন ভবিষ্যতর কোনো বিষয়ে চিন্তিত হয়, মনোযোগী হয়। 

১০. পুরুষরা জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকীর মতো দিনগুলো প্রায়শই ভুলে যান। তার মানে এই নয় যে, তারা ভালোবাসে না। অনেকের জন্য এই ভুলে যাওয়ার কারণ, তাদের ওপর বৃহৎ দায়িত্ব বা পারিপার্শ্বিক চাপ।

১১. তারা নির্দেশ পছন্দ করে না; তবে আদরের কাছে মোমের মতো গলে যায়। তাদের শিশুর মতো যত্ন করলে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়, এবং অনেক কিছুতে সহজেই সম্মত হয়ে যায়। 

১২. তারা অল্প শব্দ - বাক্যে জবাব দিতে পছন্দ করে। 

১৩. পুরুষরা মাইন্ড রিড করতে পারে না। তাই কখনো কখনো তারা  বিপদে পড়ে। 

১৪. তারা নিজস্ব কিছু সময় আশা করে পরিবারের কাছে। সেটা বাধাগ্রস্ত হলে মেজাজ বদলে যায়।

১৫. যদিও অনেক পুরুষরা পরিবারে লিডারশিপের মতো কাজ করে, তবে তারা পরিবারের প্রোটেক্টরও। 

১৬. পুরুষরা তাদের জীবনের অনেকটা সময় প্রশংসা ছাড়াই পার করে। তারা এই নিয়ে খুব একটা অভিযোগ করে না। 

১৭. পুরুষ তাদের জীবনসঙ্গীকে মেকাপ ছাড়াই পছন্দ করেন। 

১৮. পুরুষরা কাজে যাওয়ার আগ-মুহূর্তে এবং ঘরে ফেরার পর-মুহূর্তে কোনো অভিযোগ শুনতে চায় না। তারা সমস্যার কথা  শোনার চেয়ে সমাধান করতে বেশি পছন্দ করে। 

১৯. নারী যখন প্রকৃতির রূপ, গাছ, পাতালতা ফুল দেখে; পুরুষ তখন পুরো বনকে পর্যবেক্ষণ করে। 


যদি মানব প্রজাতির পুরুষ সংস্করণ না থাকতো এবং নারীরা কেবল নিজেরাই সন্তান উৎপাদন করতে পারতো, তাহলে কি বিশ্ব একটি শান্তিপূর্ণ ইগালিটেরিয়ানিজম ইথিওপিয়া বা সমতাবাদী ইথিওপিয়ায় পরিণত হতো বলে মনে করেন? কখনোই না।  রাজনৈতিক দর্শনে ইগালিটেরিয়ানিজম বা সমতাবাদ চিন্তার একটি প্রবণতা। এই সমতাবাদী কিছু সমতার পক্ষপাতী: সকল জনগণের সমান হওয়া উচিত বা একই আচরণ করা উচিত। কিছু ক্ষেত্রে সমান হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত-ইত্যাদি। অন্যদিকে ইথিওপিয়া মানে-ঈশ্বরের জন্য হলুদ সোনার উপহার। যে-কোনো উৎপাদন বিস্তার প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় প্রবৃদ্ধি ও সাফল্য সাধন করতে হলে দরকার, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বয়, সামঞ্জস্য সংরক্ষণ, উপযুক্ত উদ্যোগ, সম্প্রদায়ের সহযোগিতা, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং নৈতিক অবলম্বন ও দায়িত্ব। আর এই উৎপাদন যেমন নারীর পক্ষে একা সম্ভব নয়, তেমনি পুরুষের পক্ষেও একা সম্ভব নয়। 

কাজেই, পুরুষের প্রশংসনীয় কাজগুলো বা চিন্তা-মনোভাবকে সম্মান জানানো উচিত।

লেখক: নিউইয়র্ক-প্রবাসী শিক্ষক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক 



আরো পড়ুন