২২ ডিসেম্বর ২০২৪, রবিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

সৌমিত্রের কয়াগ্রাম

রকিবুল হাসান || ১৯ জানুয়ারী, ২০২৩, ০৪:০১ পিএম
সৌমিত্রের কয়াগ্রাম


সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাবৎ বাঙালির প্রাণের মানুষ। এই উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা। তিনি যে কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামের মানুষ তা আমরা অনেকেই জানি না। তার জন্ম কয়া গ্রামে নয়। তার বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম কয়া গ্রামে, চ্যাটার্জি পরিবারে। এই পরিবারটি বিখ্যাত একটি পরিবার। ভারতবর্ষেও স্বাধীনতা সংগ্রামে এই পরিবারের ভূমিকা অসামান্য। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে এই পরিবারের ভূমিকা মুছে ফেলা বা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। সৌমিত্র এই পরিবারেরই সন্তান। তার পিতামহরা এ গ্রামের মানুষ। এখানেই তাদের জন্ম বেড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠা লাভ, আন্দোলন সংগ্রাম সবকিছুই এ গ্রাম থেকেই হয়েছে। সৌমিত্রের প্রপিতামহ বিশাল ধনী লোক ছিলেন। বহু সম্পত্তির মালিক ছিলেন। ভূপতি বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই। শিল্প সাহিত্যচর্চায় এ পরিবারের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বঙ্গভঙ্গ-ও বিরোধিতা প্রথম সভা এই পরিবারের উদ্যোগেই এ গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিষয়টি তখনকার দিনে বহুত কঠিন ব্যাপার ছিল।

ভারতের আন্দোলন সংগ্রামে এ পরিবার যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতো, এ পরিবারের ইতিহাসে সে সব পরিষ্কারভাবে জানা যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে জানার আগে তার পিতামহদের পরিচিতি ও চ্যাটার্জি পরিবার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।

কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামের বিখ্যাত চ্যাটার্জি পরিবারের পরিচিতি ছিল গোটা ভারতবর্ষেই। পরিবারের কর্ণধার ছিলেন মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়। মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়ের পিতা ছিলেন হরসুন্দর চট্টোপাধ্যায়। এই পরিবারের প্রত্যেকটি সন্তান বিখ্যাত ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এই পরিবারটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনে এই পরিবারের অসামান্য অবদান ইতিহাসেও স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তারপরেও সে ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ নয়। যে ইতিহাস লেখা আছে তার থেকেও অনেক বেশি অবদান রয়েছে এ পরিবারের। এ পরিবারের সন্তান ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, শরৎশশী দেবী এবং নাতনি বিনোদবালার অবদান এখনো অমূল্যায়িত। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় ও হেমন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রেরণা ও শক্তি যুগিয়েছেন। নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। বাঘা যতীনকে তৈরি করেছেন। যদি পূর্ণাঙ্গভাবে এই পরিবারের অবদান ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়, তাহলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এই পরিবারটিই হয়ে উঠবে মূল সূতিকাগার।

তৎকালীন সময়ে মধুসূদন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন কয়া অঞ্চলের বিশাল ভূপতি ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি। প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে সকলের কাছে মান্যবর ছিলেন। সমাজ-সংস্কারক হিসাবে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। মধুসূদন চট্টোপাধ্যায় নয় ছেলে দু’মেয়ের জনক ছিলেন। মধুসূদনের বড় মেয়ে শরৎশশী দেবীর সন্তান বিনোদবালা দেবী ও বাঘা যতীন। দুজনেই বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা আর সুন্দর আচরণের কারণে মামাদের নয়নের মণি ছিলেন। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দু ভাইবোনই সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বাঘা যতীন ভারত স্বাধীনতা দ্বিতীয় পর্বের প্রধান নেতা ছিলেন। এখানে বলে রাখি বাঘা যতীন এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় আপন মামাতো-ফুফাতো ভাই ছিলেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বড় পিতামহ ছিলেন বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পেশাগত জীবনে প্রথমে শিক্ষকতা, পরে আইনব্যবসা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল তার। চাটুজ্য পরিবার বিখ্যাত হয়ে-ওঠার পিছনে মূল শক্তি ছিলেন তিনি। বাঘা যতীনের জীবনেও তাঁর প্রভাব ছিল অপরিসীম।

বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় জন্মগতভাবেই ধনী বাবার সন্তান ছিলেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চাটাও তিনি পারিবারিকভাবেই পেয়েছিলেন। সে-ধারাটিকে তিনি এতোটাই বিকশিত করতে পেরেছিলেন, যা রবীন্দ্র-পরিবারকেও মুগ্ধ করেছিল। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ এবং সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এ-পরিবারের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল।

বসন্তকুমারের পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল শিক্ষকতার মাধ্যমে। তিনি চুয়াডাঙ্গা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতা করতে করতেই আইন পড়েছিলেন। প্রতি রাতে আইন পড়ে হুগলী থেকে সকালের ট্রেনে ফিরে স্কুলের দায়িত্ব পালন করতেন। আইন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করার পর আইন-ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যার শুরু হয় কৃষ্ণনগরের নদীয়ার সদর জেলাবোর্ডে। সেখানে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তিনি আইনব্যবসায় ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি নদীয়ার সরকারি উকিল, কৃষ্ণনগর পৌরসভার চেয়ারম্যান, জেলাবোর্ডের সহ-সভাপতি, কৃষ্ণনগর কলেজের আইনের অধ্যাপক হয়েছিলেন।

তিনি বিখ্যাত অনেক ব্যক্তিকে মক্কেল হিসেবে পেয়েছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নদীয়ার মহারাজা, মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির রামগোপাল চেংলাঙ্গিয়া তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ আর বসন্তকুমারের কয়া গ্রাম কাছাকাছি হওয়ায়- তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরির এটিও একটা বড় কারণ ছিল।

বহু প্রতিভার অধিকারী বসন্তকুমার শুধু আইনের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য সর্বক্ষেত্রে তাঁর উজ্জ্বল পদচারণা ছিল। তিনি নদীয়ার প্রতিনিধি হয়ে মাদ্রাজ, মুম্বাই, এলাহাবাদ প্রভৃতি কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন সাহিত্য ও সমাজসেবামূলক সম্মেলনেও মধ্যমণি থাকতেন তিনি। গ্রামের মানুষের প্রতি তাঁর টান ছিল অপরিসীম। শত ব্যস্ততার ভেতরেও প্রতি সপ্তাহে তিনি কয়ায় আসতেন। সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর করতেন। বিপদে-আপদে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।


বাঘা যতীনকে তৈরি করার পেছনে তাঁর ভূমিকা অসামান্য। তাঁকে ঝিনাইদহের রিশখালি গ্রাম থেকে নিজের বাড়িতে এনে পড়ালেখা করানো থেকে শুরু করে তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপে বসন্তকুমারের ভূমিকা রয়েছে। বাঘা যতীনকে কুস্তি, লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, তলোয়ার চালানোয় পারদর্শী করে গড়ে তোলার জন্যে তিনি আফ্রিকা থেকে ফেরাজ্ খান নামে এক ওস্তাদকে নিয়ে এসেছিলেন। নিজের বাড়িতে তাকে বেতন দিয়ে রাখতেন। ফেরাজ্ খান এ-বাড়ি থেকে আর ফিরে যান নি। শেষ বয়সে এ-বাড়িতেই তিনি মারা যান। আফ্রিদি এই ফেরাজ খানকে দেখেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের প্রেরণা পেয়েছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন। বসন্তকুমারের পরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথের সুসম্পর্ক ছিল। কয়ার পার্শ্ববর্তী গট্টিয়া গ্রামের ওস্তাদ যাদুমাল চাটুজ্যে বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। বসন্তকুমারের উৎসাহ-প্রেরণায় বাঘা যতীনকে তিনি কুস্তির নানান মারপ্যাঁচ শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

বসন্তকুমার নিজে বাঘা যতীনকে কয়া স্কুল থেকে কৃষ্ণনগরে নিয়ে সেখানকার নামকরা এ.ভি. স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন এবং তাঁকে তৈরি করার জন্যে নিজে যা করণীয় মনে করেছেন, তাই-ই করেছেন। সে-সময়ে বিধবা ভাগ্নি বিনোদবালাকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করানোর মূল দায়িত্বটি তিনিই পালন করেছিলেন। নিজের পরিবারে এবং নিজের এলাকায় সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার ধারা তাঁর হাতে তৈরি হয়েছিল। নিজের গ্রামে নাটক, গান-বাজনার অনুষ্ঠান করতেন। তিনি লেখালেখি করতেন এবং অন্যদেরও লেখালেখি করতে উৎসাহিত করতেন। তাঁর পরিবারের প্রায় সবাই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি নিজে, ভাই ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, বোন শরৎশশী দেবী, ভাগ্নি বিনোদবালা লেখালেখিতে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাঘা যতীন নিজেও মামা বসন্তকুমারেরই উৎসাহ-প্রেরণায় কখনো-কখনো গল্প কবিতা লিখতেন।

বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় অসাধারণ আলোকিত মানুষ ছিলেন। যাঁর আলো সে-সময়ে নিজের পরিবার-গ্রাম ছাড়িয়ে ভারতবর্ষের বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বাঘা যতীনের জীবনগঠন প্রক্রিয়া ও আদর্শ-সংগ্রামে বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় অনিবার্য প্রভাবক একটি নাম।

হেমন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মেজো পিতামহ। কলকাতার বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন তিনি। কলকাতা ২৭৫ নং আপার চিৎপুর রোডে (শোভাবাজার) ডাক্তারি করতেন। প্রচুর আয় ছিল তাঁর। খরচও করতেন আয়ের মতোই। অর্থাৎ যেমন আয় করতেন তেমন ব্যয় করতেন। অর্থকড়ি সঞ্চয় করার চেয়ে এলাকার গরীব লোকদের সাহায্য-সহযোগিতা করাই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কয়া এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকার গরীব-দুঃস্থ ছাত্ররা তাঁর বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতো। এদের যাবতীয় খরচ তিনি নিজে বহন করতেন। খাওয়া-পরা, বেতন, বই-পুস্তুক কেনা সবকিছু। এখানেই খরচ হয়ে যেতো তাঁর আয়ের অর্ধেকের বেশি টাকা। নিজের দু’সন্তান ছিল, তাদের কথাও ভাবেননি তিনি। তাদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে আলাদাভাবে বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেননি। নিজের সন্তান আর এলাকার দুঃস্থ সন্তানদের মধ্যে তিনি কোনো পার্থক্য দেখতেন না। আশ্রিতদের সঙ্গেই তাঁর সন্তানেরা পড়ালেখা করতো। বিনোদবালা ও বাঘা যতীনও তাঁর এই মেজো মামার বাড়িতে দুঃস্থ সন্তানদের সঙ্গে থেকে পড়ালেখা করেছেন। হেমন্তকুমারের এই উদার, কল্যাণকামী ও পরোপকারী মানসিকতা বাঘা যতীনকে প্রভাবিত করেছিল। অসাধারণ মানবিক বোধ ও দায়িত্বশীল মানুষ ছিলেন তিনি।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সেজো পিতামহ ছিলেন  দুর্গাপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়। অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায় (অনাথ চ্যাটার্জি)ও তাঁর পিতামহ ছিলেন। তিনি যতীনকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। তাঁর বন্দুক ছিল। যতীন এই মামার কাছেই বন্দুক চালনা শিখেছিলেন। অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায় পেশাগত জীবনে নদীয়া মহারাজার কলকাতার এজেন্ট এবং বঙ্গীয় সরকারের সহকারী অনুবাদক ছিলেন। তিনি ‘অনাথ চ্যাটার্জি’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে তাঁর বিশেষ মর্যাদা ছিল।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহ ছিলেন ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি সুসাহিত্যিক ছিলেন এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। সে কারণে তিনি অনেকবার জেল খেটেছেন। সুসাহিত্যিক ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় খুব ভালো সাঁতার জানতেন। নৌকা চালাতেও দক্ষ ছিলেন। গড়াই ও পদ্মা নদীতে শখ করে তিনি নৌকাও চালিয়েছেন। তার ভেতর রবীন্দ্রনাথের শখের ‘বোট’ ছিল।

১৮৯৩ সালে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা ও কলেজ থেকে বি.এ. ও এল.এল.বি. পাশ করে কৃষ্ণনগরে আমরণ ওকালতি করেছেন এবং অধ্যাপনার সাথেও যুক্ত ছিলেন। বাঘা যতীন তাঁর সংস্পর্শে এসেই প্রথম রাজনৈতিক চেতনা লাভ করেন ও প্রধান সহায় হয়ে ওঠেন। (মতান্তরে, বাঘা যতীনের মাধ্যমেই ললিতকুমার বিখ্যাত লেখক-সম্পাদক যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষণের সান্নিধ্যে এসে রাজনৈতিক চেতনা লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষণের ছোট মেয়ে সুধাময়ী দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন)। তাঁরই চেষ্টায় তাঁর শ্বশুর যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের গৃহে অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে বাঘা যতীনের পরিচয় ঘটেছিল। ১৯১৫ সালে নদীয়ার শিবপুর ডাকাতি মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে কিন্তু প্রমাণের অভাবে ছাড়া পান। হাওড়া গ্যাং মামলায় কারাদ- ভোগকালে অশেষ নির্যাতন সহ্য করেছিলেন তিনি। সাহিত্যিক হিসেবেও তার সময়কালে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর ‘পারিবারিক কথা’ ও ‘দুর্গোৎসব’ পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছিল। বাঘা যতীনকে নিয়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ’। ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সন্তান মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সন্তান সোমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

কয়া অঞ্চলে একটা মিথ চালু আছে, নিমাইচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (নিমাই ব্যারিস্টার) মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়ের সন্তান । আবার অনেকের মতে, নিমাই ব্যারিস্টার চাটুজ্যে পরিবারের ছেলে নন, জামাই। কালীকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। কালী মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়ের ছোট মেয়ে। ভিন্নমতে, নিমাই ব্যারিস্টার চাটুজ্যে পরিবারের ভাগ্নে। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে হিসেবেও নিমাই নামটি উল্লেখ রয়েছে বাঘা যতীন-সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রন্থে। কুষ্টিয়া অঞ্চলে এই চাটুজ্যে পরিবারের নামের সঙ্গে নিমাই ব্যারিস্টার নামটি অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে আছে।

উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যাধ্যায় বিখ্যাত এই চ্যাটার্জি পরিবারের সন্তান। যদিও তার জন্ম কলকাতায় মাতুলায়ে ১৯৩৫ সালে ১৯ জানুয়ারি। কৃষ্ণনগরে তার বাবা ও পিতমহরা বসতি স্থাপন করেছিলেন। কয়ার চাটুর্জে বাড়ির পরিচিতি শুধু কুষ্টিয়া নয়, ভারতবর্ষেও এ পরিবারের বিশেষ একটি পরিচিতি আছে। কারণ বাঘা যতীন। বাঘা যতীনের মাতুলালয় হলেও তার জন্ম বেড়ে ওঠা সবকিছুই এখানে। যে কারণে বাঘা যতীনও এ পরিবারের সন্তান হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে বাঘা যতীনের নামেই এ পরিবার বিখ্যাত হয়ে আছে। তাঁর কারণেই এ বাড়ির পরিচিতি গোটা ভারত জুড়েই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম এ গ্রামে না হলেও তাঁর শেকড় এখানেই-এ গ্রামেই। তার পূবপুরুষরা এ গ্রামের দাপুটে ক্ষমতাশীল ছিলেন। তাঁর পিতামহের আমল থেকে চ্যাটার্জি পরিবারের সদস্যরা নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন। তবে, সৌমিত্রের পিতামহ একসময় কয়া ইউনিয়নের ‘প্রেসিডেন্ট’ (বর্তমানে চেয়ারম্যান বলা হয়) ছিলেন। এ প্রসঙ্গে অবশ্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফোনে আলাপচারিতায় আমাকে জানিয়েছিলেন, তার পিতামহ ললিতকুমার কয়া ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। তার পিতামহর বড় কোন ভাই ছিলেন। চ্যাটার্জি পরিবারের আর এক সদস্য মানিক চ্যাটার্জি দীর্ঘ বাইশ বছর কয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিও কৃষ্ণনগরে চলে যান। একসময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহ তাঁর সন্তানদের নিয়ে কৃষ্ণনগর চলে যান। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম কয়া গ্রামে। তিনি পিতা ললিতকুমারের সাথে ছোট বয়সে গ্রাম ত্যাগ করেন। সৌমিত্রের মাতা আশালতা চট্টোপাধ্যায়। মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় আইনজীবী ছিলেন। তিনি কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন এবং প্রতি সপ্তাহে কৃষ্ণনগরের বাড়িতে আসতেন। সৌমিত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পডাশোনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জনস বিদ্যালয়ে। তারপর পিতার চাকরি বদলের কারণে তাঁর বিদ্যালয়ও বদল হয়েছে বহুবার এবং তিনি বিদ্যালয়ের পডাশোনা শেষ করেন হাওড়া জেলা স্কুল থেকে। তারপর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি ও পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাশ করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস এ দু’বছর পডাশোনা করেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়। পুত্র সৌগত চট্টোপাধ্যায় ও কন্যা পৌলমী চট্টোপাধ্যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিখ্যাত অভিনেতা, আবৃত্তিকার এবং কবি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার ভিতর ১৪টিতে অভিনয় করেছেন ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যখন জন্ম, ভারত তখনো স্বাধীন হয়নি। স্বাধীনতা লাভের ১২ বছর আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মের ২০ বছর আগে তাঁদের কয়ার চাটুর্জে পরিবারের বিখ্যাত সন্তান বাঘা যতীন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দেন। কৃষ্ণনগরে থিয়েটার খুব সমৃদ্ধ ছিল। সেখানে সৌমিত্র বিভিন্ন দলের সাথে নিয়মিত অভিনয় করতেন। এটা তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। তাঁর পিতাও মঞ্চঅভিনয় করতেন।

 ১৯৫৯ সালে তিনি প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায ‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিনয় করেন। পরবর্তীকালে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয করের মতো পরিচালকদের সাথেও কাজ করেছেন। সৌমিত্র স্ক্রিপ্ট পছন্দ না হলে ছবি করেননি। সত্যজিৎ রায়ের ছবির স্ক্রিপ্টও পড়ে নিতেন অভিনয়ে সম্মতি প্রকাশের পূর্বে। সত্যজিৎ রায় যেমন সৌমিত্রকে গড়ে তুলেছেন, তেমনি সৌমিত্রও সত্যজিৎকে প্রকাশিত হতে সাহায্য করেছেন। চলচ্চিত্র ছাডাও তিনি বহু নাটক, যাত্রা, এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাড়া তিনি নাটক ও কবিতা লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন। তিনি একজন খুব উঁচুদরের আবৃত্তিকার। তাঁর পিতাও ভালো আবৃত্তি করতেন। পরিবারে সাংস্কৃতিক আবহ ছিল পুরোপুরি। তাঁর পিতা ভালো কবিতা আবৃত্তি করতেন। ওকালতির কাজকর্ম শেষ করে সন্ধ্যেবেলায় ঘরের বারান্দায় বসে কবিতা আবৃত্তি করতেন। শব্দ বাক্য যেন প্রাণ পেতো তাঁর সেই মধুময় কণ্ঠের উচ্চারণে। সৌমিত্র আর তাঁর ভাইয়েরা বাবার আবৃত্তি গভীর মনোযোগে শুনতেন। মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর সন্তানদেরও কবিতা আবৃত্তি করতে দিতেন-শিখিয়ে দিতেন বাক্যেও অনুভ’তি বুঝে কিভাবে আবেগকে ঢেলে দিতে হয়-বোঝাতেন আবেগকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সৌমিত্র বাবার সান্নিধ্যে প্রেরণায় ও সরাসরি তত্বাবধানে শৈশবেই নাটক ও আবৃত্তির পাঠ ভালোভাবেই শিখে নিয়েছিলেন। বিখ্যাত এই মানুষটি একবার টাইফয়েড হয়েছিল। ৬৩ দিন উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর নিয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী চিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও চিকিৎসক আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। মৃত্যুকে স্পর্শ করেই যেনো তিনি আবার নতুন জীবন পেয়েছিলেন।  



উত্তমকুমারের সাথে একসারিতে তার নাম নেওয়া হয়। বাংলা ছবির দর্শক এক সময় দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল-এই দুই প্রবাদ প্রতীম অভিনেতার পক্ষে বিপক্ষে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শুধু যে আর্ট হাউজ সিনেমা করেছেন তা নয়, তিনি বাক্সবদল, বসন্ত বিলাপের মতো রোমান্টিক এবং কমেডি ছবিতেও অভিনয় করেছেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোনো নায়িকার সেরকম সফল জুটি নেই। তিনি তাঁর সময়ের প্রায় সব নায়িকার সাথেই অভিনয় করেছেন। তবে মাধবী মুখোপাধ্যায় ও তনুজার সঙ্গে তাঁর রোমান্টিক ছবিগুলো চিরকালীন আবেদন তৈরি করেছে। মানুষের অন্তরে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফেলুদার চরিত্রে সব থেকে বেশি মানানসই হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফেলুদা ছাড়াও ‘কোণি’ ছবিতে মাস্টার’দার চরিত্র এবং ‘আতঙ্ক’ ছবিতে মাস্টারমশাই চলচ্চিত্রপ্রেমিদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। বাস্তবচিত ও সাধারণ মানুষের চরিত্রেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভালো কবিতা লেখেন। কাব্যগ্রন্থ আছে। বাংলা কবিতায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ কবি। কিন্তু তাঁর অভিনয়-খ্যাতির আড়ালে অনেকটাই ম্লান হয়ে আছে তাঁর কবিতাকর্ম। কবিতা লেখা বিষয়ে তিনি বলেছেন- বাঙালি তরুণদের বেলায় এটা ঘটেই থাকে। কাউকে ভালো লেগে গেল তাকে নিয়ে কবিতা লেখে। আমারও সেরকম একটা ব্যাপার ঘটেছিল। তখনকার দিনে প্রেমিকার হাত ধরতেও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হতো। প্রেমিকার মন পাবার জন্য কবিতা লেখা শুরু করি।

কয়ার মাটির প্রসঙ্গ দিয়েই এ লেখাটির সমাপন ঘটাতে চাই। বেশ কয়েক বছর আগে সৌমিত্র বট্টোপাধ্যয় ঢাকায় এসেছিলেন। একটা নামি দৈনিকে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছিল। স্মৃতিতে যতোটুকু মনে পড়ে-সেখানে একটা প্রশ্ন ছিল এরকম- আপনাকে যদি লালন সাঁই চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেয় হয়, আপনি কি তা গ্রহণ করবেন?-তাঁর উত্তরে তিনি কয়া গ্রামকে নিজের গ্রাম বলে উল্লেখ করে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। উত্তর অনেকটা এরকম ছিল-এরকম প্রস্তাব পেলে সেটা তো আমার জন্য সম্মানের। আমার শরীরে তো কয়া গ্রামের মাটি। আমার পূর্বপুরুষেরা কয়া গ্রামের মানুষ। কয়া আর ছেঁউড়িয়া তো পাশাপাশিই। আমি তো লালন চরিত্র সবচেয়ে ভালো আত্মস্থ করতে পারবো। কিন্তু আমার যে বয়স, সেটাও তো ভাবতে হবে আমাকে। এতেই তো অনুভূত হয় কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চেতনে মননে কয়া গ্রামের সন্তান-তাঁর শেকড় তো গ্রোথিত কয়ার মাটিতেই।

তার সঙ্গে আমারও কথা হয়েছে দুবার। তার জীবন সায়াহ্নের প্রায় একেবারে শেষের দিকে। সেসব আলাপচারিতায় কয়া গ্রামের প্রতি তার একটা প্রবল আকুতি ছিল। আমি যে তার নিজের গ্রামের সন্তান এটা জেনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলে এবং আবেগআপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন। খুঁটে খুঁটে জানতে চেয়েছিলেন গ্রামের কথা-নিজেদের ভিটেমাটির কথা-গড়াই নদীর কথা। শিলাইদহ কুঠিবাড়ির কথা। নিজেদের ভিটেতে বাঘা যতীন কলেজ (প্রস্তাবিত) হয়েছে জেনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন আমাদের বাড়িটা নদীতে ভেঙে গেছে না আছে! আমার ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাঘা যতীন’ বইয়ে তাকে নিয়ে লিখেছি। বইটা তাকে কুরিয়ারে পাঠানোর কথা বলতেই তিনি বললেন, না, কুরিয়ার পাঠাবেন না। আপনি যখন কলকাতা আসবেন, তখন নিয়ে আসবেন। আমি আপনার হাত থেকে বইটি নেবো। আমার গ্রামের ছেলে আমাকে নিয়ে লিখেছেন, এটা আমার জন্য বিশেষ আনন্দের।

তাকে আমার আর বইটি দেয়া হয়নি। করোনার ভয়াল থাবায় আমার কলকাতায় যাওয়া হয়নি। তিনিও চলে গেছেন পৃথিবীর সব হিসাবনিকাশ চুকে দিয়ে। এই অপূর্ণতা-এই বেদনা আমার চিরকালের হয়ে থাকলো-আমার গ্রামের কিংবদন্তি সন্তান-গোটা ভারতবর্ষের গৌরব-তাকে আমার বইটি আমার নিজে হাতে করে আর কোনদিন দেয়া হবে না। তিনিও আর আমার কাছে জানতে চাইবেন না, আমার কয়া গ্রাম কেমন আছে?



আরো পড়ুন