নরসিংদীতে প্রতি বছরই বাড়ছে সরিষার আবাদ। অল্প খরচে বেশি লাভজনক হওয়ায় এই ফসল চাষে ঝুঁকছেন এই অঞ্চলের কৃষকরা। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে অধিক ফলনের আশা করছেন কৃষকরা।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, সরিষার চাষে খরচ ও পরিশ্রম দুটোই কম হওয়ায় অনেক কৃষক এই ফসল চাষে ঝুঁকেছেন। সরিষা তোলার পর একই জমিতে বোরো আবাদসহ অন্যান্য ফসলও চাষ হয়। সরিষা বেলে, দো-আঁশ মাটিতে ভালো হয়।
সরিষা চাষে রোদ, কম তাপমাত্রা ও জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা প্রয়োজন। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ও মাটিতে রসের অভাব হলে বীজের আকার ছোট হয় ও বীজে তেলের পরিমাণ কমে যায়। এজন্য বাংলাদেশে রবি মৌসুমেই সরিষার চাষ করা হয়ে থাকে। মধ্য কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সরিষার বপন সময়।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলার ৬টি উপজেলায় ৫ হাজার ৭৮৪ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। যা লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে প্রায় ২০৪ হেক্টর জমিতে বেশি চাষ হয়েছে। চলতি মৌসুমে নরসিংদী জেলায় ৫ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছারিয়ে জেলায় সরিষার চাষাবাদ হয়। সেই মতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার মেট্রিক টন।
সরিষা নরসিংদী জেলার সব উপজেলায় কমবেশি উৎপাদন হয়। তবে জেলা সদর ও রায়পুরা এই দুই উপজেলায় অন্য চারটি উপজেলার চেয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি জমিতে সরিষা আবাদ হয়।
এ বছর নরসিংদী সদর উপজেলায় ৩ হাজার ১৪৭ হেক্টর, পলাশ ৯৪ হেক্টর, শিবপুর ১৬৩ হেক্টর, মনোহরদী ২৬৫ হেক্টর, বেলাব ২২১ হেক্টর ও রায়পুরায় ১ হাজার ৬৯০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে এখন সরিষা ফুলের হলুদের ঢেউ। যেদিকেই চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। জেলার ৬টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরিষাখেতে ফলন আসায় এমন চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আর প্রকৃতির নির্মল বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সরিষা ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ। আর মৌমাছিরাও ঘুরে বেড়াচ্ছে সরিষার ফুলে ফুলে।
এ জেলার সবচে বেশি সরিষা আবাদ হয় নরসিংদী সদর উপজেলার আমদিয়া, আলোকবালি, মহিষাসূরা, হাজীপুর, রায়পুরা উপজেলার পাড়াতলী, শ্রীনগরের ভেলুয়াচর, বাঁশগাড়ী, নিলক্ষা, চরসুবুদ্ধি, আমিরগঞ্জ, পলাশতলী ও পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল, গজারিয়া, জিনারদী ও চরসিন্দুরের। এসব এলাকায় মৌসুমে বিশাল চরের মাঠজুড়ে সরিষার চাষ করে কৃষকের বুকে নতুন আশার সঞ্চার করে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো এলাকার মাঠে সরিষা দানা বাঁধতে শুরু করেছে, আবার কোথাও পুরোদমে ফুল ফুটতে শুরু হয়েছে।
সরিষা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরিষা সাধারণত আমন ধান ঘরে তোলার পরপরই আবাদ করা হয়। পৌষ থেকে মাঘ মাসের মধ্যে সরিষা ফুলের হলুদে ছেয়ে থাকে চারদিক। এবছর বিঘা প্রতি সরিষা চাষে খরচ হয়েছে প্রায় ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি সরিষার উৎপাদন ৫ মণ হলে বিক্রি হবে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। ধানের চেয়ে কম সময়, কম পরিশ্রম ও কম খরচে বেশি লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে সরিষার আবাদ।
রায়পুরা উপজেলার আমিরগঞ্জের কৃষক শহিদ মিয়া বলেন, ‘সরিষা চাষের শুরুতে দুইবার চাষ দিয়ে ও বিভিন্ন ধরনের সার প্রয়োগ করে জমিটিকে উর্বর করে নিতে হয়। পরে সরিষার বীজ ফেলার পর তেমন আর যত্ন নিতে হয় না। এরপর আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং ফলন ভালো হলে লাভও ভালো হবে। সরিষা চাষ ধান চাষের চাইতেও লাভ বেশি। তবে গত বছরের তুলনায় এবছর সরিষার বাজারদর ভালো আছে। তাই কিছুটা লাভের দেখা পাওয়া যাবে।’
একই এলাকার কৃষক আব্দুল হালিম বলেন, ‘আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে সরিষা চাষে একদিকে যেমন লাভবান হচ্ছি, অন্যদিকে সরিষার পাতা পচে জৈব সার হিসেবে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করছে এই সরিষা চাষ। এতে পরবর্তী সময়ে ধান চাষে খরচ অনেকটা কম হবে। এছাড়া সরিষা চাষের পাশাপাশি সরিষা শাক ও সরিষা ফুল বিক্রি করেও অতিরিক্ত উপার্জন করা সম্ভব।
রায়পুরা উপজেলার নিলক্ষার কৃষক রব মিয়া জানান, স্বল্প খরচে অধিক ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় প্রতিবছরই সরিষার আবাদ বাড়ছে। তাছাড়া বীজ বোনার সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে সরিষার ফলন ঘরে তোলা যায়। পরে ধান আবাদেও কোনো সমস্যা হয় না। সামান্য ইউরিয়া ছাড়া আর কোনো সার দেওয়ারও প্রয়োজন হয় না।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ পরিচালক ড. মো. মুহাম্মদ মাহবুবুর রশীদ জানান, সরিষা চাষে কৃষকরা যেভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে, তা অত্যন্ত ইতিবাচক। এটি কৃষি ক্ষেত্রে সরকারের আরও একটি সাফল্য। দেশি জাতের সরিষার ৬০ থেকে ৭০ দিনে এবং উচ্চ ফলন শীল জাতের সরিষা উঠতে সময় লাগে ৭৫ থেকে ৮০ দিন। তিনি আরও বলেন, সরিষার আবাদ বৃদ্ধি হলে তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়বে এবং তেলের আমদানী নির্ভরতা কমে যাবে।
ঢাকা বিজনেস/এম