টাঙ্গাইলের মধুপুরে আনারসের মৌসুম এলে কৃষক, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের ফল পরিচর্যা বাছাই, সংগ্রহ ও আড়তে নেওয়া পর্যন্ত চলে মহা কর্মযজ্ঞ। গড় এলাকার হাটগুলোতে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত চলে আনারস বিক্রি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখোর থাকে এই অঞ্চল। চাষিরা বলছেন, এবার হাটগুলোর চিত্র বদলে গেছে। আনারসের বাম্পার ফলন হলেও হাটগুলোতে ক্রেতা নেই। গত দশ বছরের মধ্যে এবার আনারসের বাজারে সবচেয়ে বড় ধস নেমেছে। দাম না থাকায় উৎপাদন খরচ তোলা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ব্যাংকঋণ, সারের দাম পরিশোধ, শ্রমিকের মজুরিসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ের ধকল পোহাতে হচ্ছে চাষিদের। তাই তাদের কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর মধুপুরে ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এলাকায় প্রতি হেক্টর জমিতে আনারসের গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩৮-৪০ মেট্রিকটন। উৎপাদন হবে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৬০০ মেট্রিকটন। গতবারের চেয়ে এ বছর আনারসের চাষ বেশি হয়েছে। মধুপুরে জায়েন্টকিউ, হানিকুইন ও এ বছর বিশ্ববিখ্যাত ফিলিপাইনের সুপার সুইট এমডি-২ জাতের আনারস চাষ হয়েছে।
সরেজমিনে জলছত্র, মোটের বাজার, গারোবাজার, ইদিলপুর, পিরোজপুর, দোখলা, সাইনামারি ও আউশনারা গিয়ে চাষি ও পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত বছরের চেয়ে এ বছর আনারসের চাষ বেশি হয়েছে। বাণিজ্যিক চাষের ফলে অতি মুনাফা লোভীদের থাবায় জৌলুস হারাচ্ছে রসালো ফল আনারস। অপরিপক্ক গাছে অসময়ে আনারস বের করার জন্য অসাধু পন্থা বেছে নিয়েছে অনেক বাণিজ্যিক চাষিরা। দেদারছে ব্যবহার করছে নামে বেনামে নানা কোম্পানির কেমিকেল। বড় ফল ও হরমোন ব্যবহার করে বাজার দখল করার মানসিকতার কারণে সার কেমিকেলের অতিরিক্ত খরচ। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে পরিবহনের খরচ বৃদ্ধি, বাড়তি শ্রমিক মজুরি ও পাইকারদের উপস্থিতি কম থাকায় সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় চাষিরা।
আনারস চাষি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রতিটি আনারসের চারা জমিতে আনা পর্যন্ত হাল চাষ রোপণসহ খরচ হয়েছে ৮-৯ টাকা। এখন বাগান থেকে আনারস কাটতে শ্রমিক মজুরি ১ টাকা। ভ্যান ভাড়া ৫ টাকা। পরিচর্যা খরচ বাদেই প্রতিটি আনারসে খরচ হয়েছে ১৪-১৫ টাকা। ১৮ মাস পরিচর্যার পর আনারস বিক্রির উপযোগি হয়েছে। এ সময় সার, পোকামাকড় দমনে রাসায়নিক, রোদে পোড়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য খড় দিয়ে ঢেকে দেওয়াসহ খরচ হয়েছে প্রতি আনারসে ৭-৮ টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিটি আনারসে গড় খরচ পড়েছে ১৮-২২ টাকা। বাজারে আনারস বিক্রি করে খরচ বাদে হাতে আসছে গড়ে ১৪-১৭ টাকা।
বানিয়াবাড়ি গ্রামের কলেজ শিক্ষক লিয়াকত হোসেন বলেন, স্থানীয় এক কৃষকের কাছে আমার দেড় একর জমি আনারস চাষের জন্য বর্গা দিয়েছিলেন। ২৩ হাজার জলডুগি আনারস খরচ বাদে ৮ টাকা হারে দাম পেয়েছিলাম।
গারো বাজারের সাজ্জাদ রহমান বলেন, গত বছর যে আনারস ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, চাহিদা কম থাকায় এ বছর ৩০-৩৫ টাকার বেশি দিয়ে নিতে চাচ্ছে না পাইকাররা।
কুষ্টিয়ার আড়ৎদার শাহজাহান আলী বলেন, ‘এবার আনারসের চাহিদা কম। অন্যান্য বছর সকালে ট্রাক থেকে আনারস আড়তে নামালে খরিদ্দার ভীড় জমাতো। এখন ভীড়ও কম, দামও কম। যে আনারস অন্য সব বছর ৬০-৭০ টাকা বিক্রি হয়। এ বছর হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা।’
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল জানান, ‘ মধুপুরে এবছর ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এ এলাকায় প্রতি হেক্টর জমিতে আনারসের গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩৮-৪০ মেট্রিকটন। এ বছর গতবারের চেয়ে আনারসের চাষ বেশি হয়েছে। মধুপুরে তিন ধরণের আনারস চাষ হয়ে থাকে। গড় এলাকার লাল মাটিতে জায়েন্টকিউ বা ক্যালেন্ডার জাতের আনারস সব চেয়ে বেশি চাষ হয়ে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকার কারণে এ এলাকার আনারস সারাদেশে সমাগম ঘটে থাকে। নিরাপদ আনারস চাষের উপর কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ নানা ধরণের পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হয়ে থাকে ।’
কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মধুপুর গড়ের আনারসের ঐতিহ্য ফিরাতে হলে চাষি কৃষক পাইকারসহ সংশ্লিষ্টদের সচেতন হতে হবে। ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার রোধে সকল কে এগিয়ে আসতে হবে। এতে কমে আসবে ঊৎপাদন খরচ।’