গাড়িটি সাই সাই করে এগিয়ে চলছে সাপের মতো আঁকাবাকা বন্ধুর পাহাড়ি পথে, গন্তব্য খাগড়াছড়ি। মৌরি আর সফল যৌথগলায় গাইছে, ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায়, দেখেছিলাম বায়োস্কোপ।’মৌরির বাবা শফিক সাহেব।সরকারের যুগ্মসচিব। সফলের বাবা কামরান সাহেব। তিনি পুলিশের আইজি। মৌরি বাবা-মায়ের বড় মেয়ে। ভিকারুননিসা নুন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছে। সফলও বাবা-মায়ের বড় ছেলে। পড়ছে বুয়েটে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।
বৃহস্পতিবার রাত আটটায় এলিফ্যান্ট রোড থেকে রওয়ানা হয়ে খাগড়াছড়ি যাত্রা বিরতি নিয়ে দুপুর বারোটায় সবাই পৌঁছে যান সাজেক ভ্যালি। সবাই গোসল সেরে ঝরঝরে হয়ে দুপুরের খাবার খেতে যায়। বাম্বু চিকেন, সরষের তেল দিয়ে আলু ভর্তা, আর সবজি ডাল দিয়ে খাবার বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে সবার কাছে। সিদ্ধান্ত হয়, একটু বিশ্রাম নিয়ে তারা বিকেলে কংলাক পাহাড় দেখতে যাবে।
নীল জিন্স, লাল টি শার্ট, লাল লিপস্টিক কোমর অব্দি ছেড়ে দেওয়া চুলে মৌরিকে অপূর্ব লাগছে। সফল লুকিয়ে দেখছে মৌরিকে। খেয়াল করেছেন শফিক সাহেব আর কামরান সাহেব দুজনেই। দুজনেই ভাবছেন হলে হোক না, ভালোই তো! গাড়ি কাঁচা রাস্তা দিয়ে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে পৌঁছে যায় কংলাক পাহাড়।
মৌরি ভীষণ উত্তেজিত পাহাড়ে ওঠার জন্য। সফলের পছন্দ সমুদ্র, সে উঁচুতে উঠতে ভয় পায়। মৌরির সঙ্গে ওঠে সফলের ছোট ভাই সুমন।
কংলাক পাহাড়ে উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে যায় মৌরি। সুমন অনেক আগে উঠে যায় মৌরির। হঠাৎ একটা লম্বা হ্যান্ডসাম উপজাতি ছেলে হাত বাড়িয়ে দেয়, can I help you? মৌরি ওঠে তার হাত ধরে। এক সোনালি বিকেলে দেখা হয় মৌরির সঙ্গে এই ছেলের। ছেলেটি হেসে বলে, আমি রোলেন। মৌরি হ্যান্ডসেক করে পরিচিত হয়।
মৌরি আর রোলেন দুজনে মিলে দেখে পাহাড়ের ওপরটা। রোলেন জানায়, সে মারমা উপজাতীয়। খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পা করেছে। মৌরি জানতে চায়, রোলেন কোথায় ভর্তি হতে চায়? রোলেন জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এবার নিচে নামতে হবে।
নামার আগে মৌরি আর রোলেন মোবাইল নাম্বার বিনিময় করে। মৌরি জানায় রোলেনকে সে বুয়েট অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের `ক' ইউনিটে ভর্তি হতে চায়। নামার সময়ও সুমন আগে নেমে যায়। মৌরি নামে রোলেনের হাত ধরে। নিচে নেমেই রোলেনকে বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় মৌরি।
ফেরার পথে গাড়িতে সফল একদম চুপ হয়ে বসে আছে। মৌরি পাহাড়ে উঠতে পেরে খুব আনন্দিত। মোটেলে ফেরার পর রোলেন ফোন দিয়ে খোঁজ নেয় মৌরি ঠিকভাবে পৌঁছালো কিনা। রোলেন আরও জানতে চায়, মৌরি কবে নাগাদ ঢাকায় ফিরবে? মৌরি জানায় রোলেনকে সে আর একদিন আছে খাগড়াছড়ি। রোলেন পরের দিন সন্ধ্যায় মৌরিকে কফির দাওয়াত দেয়। মৌরি কথা দেয় যাবে। মৌরি একটা কালো সিল্কের শাড়ি, মুক্তার গহনা আর চুল খোপা করে দেখা করে রোলেনের সঙ্গে। সঙ্গে যায় সুমন আর মৌরির কাজিন মহুয়া। শ্যামবর্ণ, চোখে কালো ফ্রেমের চশমাপরা রোলেনের বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা মৌরির বেশ ভালো লাগে। মৌরিকে রোলেন থামি, শাল, উপজাতিদের তৈরি ব্যাগ উপহার দেয়।
শফিক সাহেবের অনুরোধেই মৌরিকে ভর্তি পরীক্ষার জন্য পড়াতে আসে সফল। এর আগে সফল এলে মৌরি হালকা পাতলা সাজগোজ করতো। কিন্তু ইদানিং একদম সাদামাটা থাকে। রোলেন আর মৌরির প্রায়ই কথা হয় মোবাইল ফোনে।
রোলেন এড হয়েছে মৌরির ফেসবুক আইডিতে।
দেখতে দেখতে চলে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। রোলেনকে মৌরি জানায়,পরীক্ষা শেষ রোলেন যেন মৌরির সঙ্গে দেখা করে। মৌরি আর রোলেন ঘুরে ধানমন্ডি লেক,ক্রিসেন্ট লেক। দুপুরে খাওয়া শেষ করে রোলেনকে মৌরি গিফট করে শার্ট আর পারফিউম।
ভর্তি পরীক্ষার ফল বের হলে দেখা যায় রোলেন মেধা তালিকায় প্রথম দিকে আর মৌরি অপেক্ষামান তালিকায়। এবার মৌরিকে ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা খুব ভালো করে দিতে হবে। ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষায় মৌরি ভালো করে। সে ভর্তি হয় অর্থনীতি বিভাগে আর রোলেন মাইক্রোবায়োলজিতে।
দেখতে দেখতে চলে আসে রোলেনের ঢাকা আসার দিন। আজ সন্ধ্যায় রোলেন ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হবে। বিকেলে পিয়ালি আসে রোলেনের সঙ্গে দেখা করতে। জল ভরা চোখে রোলেনের দিকে তাকায় পিয়ালি। পিয়ালি তার চেয়ে দুই বছরের ছোট, তার খেলার সাথী। সেই ছোট বেলায় পুতুল খেলতে খেলতেই পিয়ালি মন দিয়ে বসে আছে রোলেনকে। পিয়ালি বলে,আমি তোর যোগ্য না এই আমার নিজের হাতে বোনা সোয়েটারটা রাখ। অনেক বড় হবি তুই। বড় একটা স্যার হইস। অনেক ভালো থাকিস। রোলেন পিয়ালিকে আলিঙ্গন করে। পিয়ালির কপোল বেয়ে পড়ে শ্রাবণধারা।
রোলেন মৌরি দুজনেই পড়ালেখায় বেশ মনোযোগী। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে চলে দুজনের প্রতিদিন দেখা হওয়া। কখনো মৌরি যায় মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে, কখনো রোলেন আসে অর্থনীতি বিভাগে। ক্যাম্পাসে দুজনের বন্ধুত্ব মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কেউ কেউ তাকে প্রেম বলেই মানতে চায়। ক্যাম্পাসে উপজাতীয় মেয়েরা রোলেনকে বেশ ক্ষ্যাপায় কিরে বাঙালি মেয়েকে মন দিয়ে বসে আছিস! জানিস তো সমতলের মানুষ খুব জটিল আর স্বার্থপর।
মৌরি, রোলেন ৩য় বর্ষে। দুজনের পড়াশোনা বেশ ভালোভাবেই এগুচ্ছে। সেদিন ছিল রোলেনের জন্মদিন। মৌরি লাল জামদানি পরে রোলেনের সঙ্গে দেখা করতে যায়। দুজনে মিলে অনেক ঘোরাঘুরি করে। দুপুরের খাওয়ারের পরে দুজনে মিলে যায় ধানমন্ডি লেকে। মৌরিকে রোলেন জিজ্ঞেস করে, তুমি আমাকে পছন্দ করো? মৌরি দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে, কেমন পছন্দ? রোলেন বলে, হেসো না আমার জীবনের সিদ্ধান্ত। মৌরি বলে বেশ হাসবো না বলো। রোলেন বলে, তোমার ওই সুগভীর চোখে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। অন্য কোনো নারীকে আমি ভাবতে পারি না। মৌরি বলে, ভাবলে তোমাকে আমি খুন করে ফেলবো। তারপর দুজনে হেসে দুজনের কাঁধে লুটিয়ে পড়ে।
সফলের বিএসসি. ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সমাপনী পরীক্ষা শেষ করে থিসিসের কাজ করছে। মৌরিকে ফোন দিয়ে বলে, তোমার ক্যাম্পাসে একটু আসতে চাই। মৌরি বলে, জি সফল ভাই আসেন। মৌরি আর সফল দুজনে মধুর ক্যান্টিনে যায়। মৌরি সফলের জন্য মিষ্টি, পাটিসাপটা আর চায়ের অর্ডার দেয়। সফল বলে, মৌরি আমি স্পষ্ট কথা বলতে পছদ করি। আমি তোমাকে পছন্দ করি। জীবনের যাত্রায় তোমাকে পাশে চাই। তুমি হ্যাঁ বললে আমি বাসায় কথা বলবো। মৌরি বলে, সফল ভাই তুমি আমার আইডল, আমার মেনটর। কিন্তু ওভাবে তোমাকে আমি ভাবতে পারবো না। সফল বলে, বেশ সুখী হও।
জীবনের কোনো পর্যায়ে যদি আমার কোনো সহযোগিতা দরকার হয়, বলতে দ্বিধা করো না। মৌরি কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বলে, আচ্ছা। ভালো থেকো সফল ভাই।
মৌরি আর রোলেন চতুর্থ বর্ষ। আসে বিসিএস পরীক্ষা। রোলেনকে তাড়া দেয় মৌরি, সে যেন প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি পায়। রোলেন সারাদিন সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে বসে পড়ে। মৌরি দিনে একবার এসে দেখা করে যায়। কখনো দুপুরে এসে একসঙ্গে খাবার খায়, কখনো শাড়ি পরে এসে বিকেলের চা নাস্তা একসঙ্গে খায়। রোলেন প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যায়।
বিসিএস পরীক্ষা বেশ ভালোভাবেই শেষ করে রোলেন। এবার ওরা এমএ তে। অনার্স পরীক্ষার ফল রোলেনের চেয়ে মৌরির ভালো। মৌরি প্রথম শ্রেণী পেয়েছে আর রোলেন ২য় উচ্চতর শ্রেণী। সফল ৩.৭ সিজিপিএ নিয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছে। এবার উচ্চশিক্ষার পালা। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে সফল চলে যায় ইংল্যান্ড। যাবার সময় মৌরির সঙ্গে দেখা করে একটা কফিশপে। মৌরি একটা টিশার্ট উপহার দেয় সফলকে। সফল জানায়, যেকোনো প্রয়োজনে সে মৌরির পাশে থাকবে।
বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। রোলেন প্রথম একশত জনের ভেতর আছে। ভীষণ আনন্দিত মৌরি। মৌরি একদিন রোলেনকে বাসায় দাওয়াত দেয়। পছন্দ করে মৌরির সব পছন্দের রান্না। রোলেনও পেট পুরে খায়। রোলেনকে পরিচয় করিয়ে দেয় বাবা, মায়ের সঙ্গে। মৌরির বাবা খুব প্রশংসা করে রোলেনের।
মৌরি লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে। এবার শফিক সাহেব মৌরিকে বিয়ে দিতে চান। বলেন, তুমি বললে আমি কামরান সাহেবের সাথে কথা বলব। মৌরি বলে, বাবা আমি রোলেনকে বিয়ে করবো। শফিক সাহেব বলেন, সেটা কী করে সম্ভব! ও একটা মারমা ছেলে। ও কি মুসলিম হবে তোমার জন্য? মৌরি বলে, হ্যাঁ বাবা হবে। শফিক সাহেব বলেন, ছোট বেলা থেকে তুমি যা চেয়েছ তাই দিয়েছি। সেটাই বড় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোলেনকে পরশুদিন আমার অফিসে নিয়ে আসো, আমি ওর সাথে কথা বলব।
পরের দিন মৌরি দেখা করতে যায় রোলেনের সঙ্গে। রোলেনের প্রিয় রঙ সবুজ শাড়ি পরে। লাল লিপিস্টিক আর লাল টিপে মৌরিকে অপূর্ব লাগছে। মৌরি আর রোলেন মধুর ক্যানটিনে বসেছে। মৌরি বলে পাপা যদি তোমাকে মুসলিম হতে বলে? রোলেন বলে, আমি দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আছি। মৌরি প্রশান্তির হাসি হাসে। দুজনে মিলে যায় শফিক সাহেবের অফিসে। শফিক সাহেব দুপুরের খাবার অর্ডার করে রোলেন আর মৌরির জন্য। লাঞ্চ খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করে, রোলেন তোমার আর ভাইবোন কে আছে? রোলেন বলে, আমি একা। শফিক সাহেব জিজ্ঞেস করেন, তুমি মৌরিকে ভালোবাসো? রোলেন বলে, বাসি। মৌরির জন্য তুমি তোমার ধর্ম, পরিবার ছাড়তে পারবে? রোলেন স্পষ্ট উত্তর দেয়; অদেখা দেবতার জন্য আমি আমার আরাধ্য প্রেমকে ছেড়ে দিতে পারবো না। আর বাবা, মায়ের দেখাশোনা আমি করবো। শফিক সাহেব বলেন, বেশ তাই হবে। দুই মাস পরে তোমাদের বিয়ে। তোমার বাবা, মা যেন অবশ্যই বিয়েতে আসেন।
সেদিন মৌরি আর শফিক বেরিয়ে সিনেমা দেখে, একসঙ্গে ডিনার করে, রাতে রোলেন মৌরিকে বাসায় পৌঁছে দেয়। দেখতে, দেখতে চলে আসে বিয়ের সময়। শফিক সাহেব মেয়ের বিয়ের জন্য পাশের দেশে পাঠিয়েছেন লেহেঙ্গা, শাড়ি, কসমেটিকস, স্বর্ণ সব কেনাকাটার জন্য। রোলেনও একবারে টাকা দিয়ে দিয়েছে। বিয়ে সম্পন্ন হয় মহা ধুমধামে। রোলেন হয়ে যায় রাজীব আহমেদ। বিয়ের পরে শফিক সাহেব মেয়ে, জামাইকে ইন্দোনেশিয়া পাঠিয়ে দেন মধুচন্দ্রিমায়।
রোলেনের ট্রেনিং শুরু হয় সাভার লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সপ্তাহান্তে আসে। মৌরি ধীরে ধীরে রোলেনের পছন্দ, অপছন্দ জানার চেষ্টা করছে। রোলেনের পছন্দের দু একটা ভর্তা করে। কখনো রাতভর গল্প করে, মৌরি আবৃতি করে শোনায়। জীবন যেন ওদের কাছে এক ময়ুরপঙ্ক্ষী নাও। তাতে ওরা দুজন কেবলই ভেসে বেড়াচ্ছে। রোলেন, সবসময়ই রাজীব আর মৌরিকে খুশি করার অনেক চেষ্টা করে। বাবা, মাকে নিয়মিত টাকা পাঠায় কিন্তু পাহাড়ে আর ফেরা হয় না।
দুই বছরের মাথায় মৌরি কনসিভ করে। এরই মধ্যে মৌরি জি.আর.ই দিয়েছে। কিন্তু পিছিয়ে গেল উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য বিদেশে পাড়ি জমানো। সফল মাঝে, মাঝেই মেসেঞ্জারে স্কলারশিপের খোঁজ খবর দিয়েছে। রাজীবের পোস্টিং করিয়ে এনেছে সমাজ কল্যান মন্ত্রণালয়ে। শফিক সাহেবও খুব খুশি রাজীব কে তিনি নিজের আরেকটি ছেলেই ভাবেন। তার মনে হয়;ও সমতলেরই ছেলে। ও কোনদিন পাহাড়ে ছিল না।
মৌরি যেন একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছে। সারাদিন মায়ের খেয়াল, বাবার না চাইতেই সব হাজির করা এসবের পরেও মৌরি রাজীবকে আরও কাছে চায়। রাজীব চেষ্টা করে খুব। কিন্তু সারাদিন অফিস শেষ করে অনেক সময়ই আর সাথে সাথেই ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করে না। তাছাড়া আজকাল প্রায়শই তার মনে হয়, সে নিজেকে কোথাও হারিয়ে ফেলেছে। এরই মধ্যে পাহাড়ের এক বন্ধুর কাছে পিয়ালি চিঠি পাঠিয়েছে। ইনিয়েবিনিয়ে লিখেছে যে রোলেন তার ছোট বেলার বন্ধু এবং ভালোবাসাকে একেবারেই ভুলে গেছে। রাজীবের চোখের কোনে জল বেরিয়ে আসে। রোলেনকে সে কী কোথাও হারিয়ে ফেলেছে? এরই মধ্যে একদিন এক পাহাড়ি বন্ধুকে রাজীব বাসায় নিয়ে আসে। ব্যাপারটা নিয়ে শফিক সাহেব এবং মৌরির মা দুজনেই বিরক্ত। মৌরি অবশ্য বাবা, মাকে বলেছে ও তো প্রতিদিন নিয়ে আসে না।
দেখতে, দেখতে মৌরির বাচ্চা হওয়ার সময় চলে আসে। রাজীব মৌরিকে স্কয়ারে সবচেয়ে বড় গাইনোকোলজিস্ট এর কাছে ডেলিভারি করায়।
ফুটফুটে একটা পুত্র সন্তান হয় মৌরি আর রাজীবের। ছেলেকে কোলে নিয়েই রাজীবের মনে হয়, আজকে কে বাবা হল? রোলেন না রাজীব!
রাজীব খবর দেয় বাবা মাকে। বলে, তোমরা এসে তোমাদের বংশধর দেখে যেয়ো। রাজীবের বাবা মা আসেন দৌহিত্রর জন্য বিভিন্ন রঙের চীবর বানিয়ে।
নিয়ে আসে পাহাড়ি ফল, লেবু, মৌরির জন্য থামি।
এসব দেখে রাজীবের চোখে জল চলে আসে। শফিক সাহেব একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, চমৎকার সব উপহার এনেছেন দেখছি। রাজীব ভদ্র এবং দৃঢ় কন্ঠে বলে, উনারা ওনাদের ঐতিহ্য এবং বিশ্বাস অনুযায়ী সাধ্যের সেরা উপহার এনেছেন। শফিক সাহেব বলেন, তাই তো!
বাচ্চার তিনমাস বয়স হলে রাজীব মৌরিকে বলে, আমি আলাদা বাসা নিতে চাই। মৌরি বলে এত ছোট বাচ্চা নিয়ে আমি কিভাবে থাকব? ঋদ্ধ একটু বড় হোক। রাজীব নিজেই পছন্দ করে নাম রেখেছে ঋদ্ধ। এবার ছয়মাস হলে রাজীব বাসা দেখতে চায়। কিন্তু মৌরি বলে বাবুর দুই বছর হোক। আলাদা বাসায় ঋদ্ধ কে দেখবে কে? আমি তো ইউনিভার্সিটি জয়েন করব। রাজীব বলে আপাতত তুমি চাকরি বাদ দাও। আমি তোমার বাবার বাসায় আর থাকতে পারব না। একদিন অফিস থেকে বাসায় এসে রাজীব জানায়, বাবা অসুস্থ আমি কাল সকালে খাগড়াছড়ি যাব। খাগড়াছড়ি গিয়ে রাজীব যেন রোলেনকে ফিরে পায়। দেখা হয় পিয়ালির সাথে। পিয়ালি এক ছেলে নিয়ে ফিরে এসেছে বাপের বাড়ি। স্বামী দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। সেদিন সারাদিন পিয়ালি আর রোলেন ঘোরাঘুরি করে।
প্রায় এক সপ্তাহ পর রোলেন ঢাকায় ফেরে। মৌরিদের বাসায় এসে দেখে অনেক আয়োজন। সফল এসেছে। মৌরি বেশ সাজগোজ ও করেছে। রোলেনও খাবার টেবিলে জয়েন করে। রোলেন কথাপ্রসঙ্গে জানতে চায়, সফল ভাই এখনো একাই আছেন? সফল হাসতে হাসতে বলে এখন একাই আছি। এক আইরিশ সুন্দরীর সাথে লিভিং করতাম। সেসব চুকেবুকে গেছে। বাবা, মা প্রেশার দিচ্ছেন বিয়ের জন্য। রাতে যখন মৌরি রাজীব বলে ডাক দেয়। রোলেন বলে, রাজীব না রোলেন বলবে। মৌরির চোখেমুখে বিষ্ময়। আজকাল প্রায়শই রোলেন অন্যপাশ ফিরে শুয়ে কাটিয়ে দেয়। এভাবেই কেটে যাচ্ছে সময়। ইতিমধ্যে রোলেন জানিয়েছে সে একার জন্য বাসা খুঁজছে।
একদিন রাত দশটায় বাসায় ফিরে দেখে মৌরি বাসায় নেই। মৌরির মায়ের কাছে জানতে চাইলে বলেন, মৌরি আর ওর বাবা সফলদের বাসায় দাওয়াতে গিয়েছেন। মৌরি তো তোমাকে ফোন করেছিল, তুমি তো বললে দেরি হবে। তাই ওরা গিয়েছে। সকালে উঠে মৌরি, বিছানায় একটা চিঠি পায়। রোলেন লিখেছে,
"যেদিন তোমাকে পাহাড়ের চূড়ায় প্রথম দেখেছিলাম। তোমার চোখে এক অদ্ভুত আলো দেখেছিলাম। সেই আলোর উৎস ছিল হয়তো বা তোমার মন। তাকে ছুঁয়ে দেখতে আমি সব ছেড়ে রাজীব হয়েছিলাম। আমি তোমার জন্য পরিবার, ধর্ম সব ছাড়লাম আর তুমি বাবার বাসাটাই ছাড়তে পারলে না। আজও তোমাকে সেই প্রথম দিনের বাসরের মতোই ভালোবাসি। কিন্তু রোলেন হিসেবে, রাজীব হয়ে না। যদি পাহাড়ে আসতে পারো আমি তোমারই থাকব। কিন্তু যে বাবার বাসাই ছাড়তে পারে না, সেকি নিজের লোকালয় কখনো ছাড়তে পারে? তোমার ভবিষ্যত অবারিত করে দিলাম। ডিভোর্স পাঠালে সাইন করে দেব। ঋদ্ধর খরচ প্রতিমাসে পাঠিয়ে দেব। ও যেদিন ওর শিকড় খুঁজতে চাইবে ওকে বাঁধা দিও না। তোমার পথচলা অবারিত হোক।"
- রোলেন
খাগড়াছড়ি শুরু হতে যাচ্ছে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান সাংগ্রাই। রোলেন পিয়ালির জন্য উপহার এনেছে রুপোর বিছা, গলার মাদলি, নতুন শাড়ি। আজ সে সেই ছোট বেলার মতো পিয়ালির সাথে সাংগ্রাই খেলবে। সন্ধ্যায় কফিশপে মৌরিকে সফল প্রপোজ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা যেতে। মৌরি বলে আমি তোমার প্রিয় সমুদ্রে যাব। সফল হাত ধরে বলে বেশ!
ঋদ্ধ তখন পিএসফোরে খুঁজে ফেরে শৈশবের সবটুকু আনন্দ।