আগামী
বছর বিশ্বমন্দা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাম্প্রতিক যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে
দেশে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ মহাসচিবের
সঙ্গে তার বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবাই খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে
২০২৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায়
দেশের জনগণকে এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন,
‘আমাদের জমি অত্যন্ত উর্বর। তাই কোনো জমি যেন অনাবাদি না থাকে।’
মানুষের
প্রতি সঞ্চয় বাড়ানোর তাগিদ আছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি এমন এক পর্যায়ে
পৌঁছেছে যে জিনিসপত্রের দাম মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। বলা হচ্ছে, যে
পারছে সে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে, যার সঞ্চয় নেই সে কম খাচ্ছে। এগুলো কোনো কোনো
ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত মনে হলেও বাস্তবতা হলো মানুষের আয় বাড়েনি, খরচ বেড়ে
গেছে বহুগুণ। খুব কম মানুষই এই অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে। আমরা
যে উন্নয়নের সংগ্রাম করছি, সেটা নির্ভর করছে দেশের জাতীয় সঞ্চয়ের ওপর।
মানুষের ব্যক্তিগত সঞ্চয় কমলে জাতীয় সঞ্চয়ও কমবে। সঞ্চয় না থাকলে বিনিয়োগ
করাও সম্ভব হয় না।
দীর্ঘদিন ধরে অতিমারিতে পর্যদুস্ত সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ শতগুণ বাড়িয়েছে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি যার প্রভাব পড়েছে গণপরিবহনে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে, চিকিৎসা ও সন্তানের লেখাপড়ার খরচে। সরকার যেভাবেই বলুক, যত যুক্তিই দেখাক, সত্যটা হলো জ্বালানি তেলের এমন চড়া যে,তাতে বাড়িয়ে দিয়েছে সব জিনিসের দাম। বাড়তে থাকা জীবনযাপনের খরচে সাধারণ রোজগেরে মানুষ যখন দিশাহারা, তখন আকস্মিকভাবে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি বিপিসিকে বাঁচাতে মানুষের পকেটে হাত দিলো সরকার। গত ৫ সেপ্টেম্বর যখন সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় তখন বিশ্বাজারে তা বাড়তি ছিল না, এখনো নেই। তাই একথা সত্য যে, বহু মানুষ খরচ সামলাতে সঞ্চয়ে হাত দিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রবীণদের অনেকে কাজ খুঁজছেন।
মানুষের
প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছে এবং তার ফলে সঞ্চয়ও কমে গেছে। পূর্ববর্তী বছরের
জুলাই মাস থেকে পরবর্তী বছরের ২০২১ সালে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৩৭,৩৮৫
কোটি টাকার। পরবর্তী ২০২২-এর একই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৮,১৫৭
কোটি টাকা। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হ্রাস পেয়েছে ৫০ শতাংশের মতো।
পূর্ববর্তী বছরের জুলাই থেকে মে ২০২১ পর্যন্ত এ আমানত ছিল ১,৪৩,৪৪৭ কোটি
টাকা। এতে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ৫৪.৯৮ শতাংশে দাঁড়ায়। পণ্য ও সেবার দামে বেশি
হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প ও মধ্যআয়ের মানুষ। ব্যয়ের সঙ্গে আয় না বাড়ায় জীবিকা
নির্বাহ করতে একদিকে জীবনযাত্রার মানে লাগাম টানতে হয়েছে, অন্যদিকে হাত
পড়েছে সঞ্চয়ে। সঞ্চয় ভেঙে সংসার খরচ সামলাতে হচ্ছে বলে সঞ্চয়ের স্থিতি কমে
যাচ্ছে। এমনি করে নতুন সঞ্চয়ের গতিও হ্রাস পাচ্ছে। ফলে ব্যাংক, আর্থিক
প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সঞ্চয়ের স্থিতি কমেছে।
বাজারের
অধিকাংশ পণ্য ও পরিষেবার দাম নির্ধারিত হয় উৎপাদনের খরচের সাপেক্ষে।
প্রতিটি স্তরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে কোনো কিছুই নাগালের মধ্য নেই।
অর্থনীতিতেও স্থবিরতা থাকায় মানুষ আয় বাড়াতে পারছে না, কাজ বাগাতে সক্ষম
হচ্ছে না। মূল্যবৃদ্ধি ব্যাপারটা সবাইকেই আঘাত করছে। পণ্য ও পরিষেবার মূল্য
বেড়ে গেলে টাকার অঙ্কে মানুষের আয় অপরিবর্তিত থাকলেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা
কমে। দেশের অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হলে নিয়ন্ত্রিত মাপে
মূল্যবৃদ্ধি হওয়া প্রয়োজন, সেটা সরকার করতে পারছে না।
সমাজের
দরিদ্রতর মানুষের ওপর প্রবল চাপ তৈরি করছে মূল্যবৃদ্ধি। এই পরিবারগুলোর
আয়ের সিংহভাগ যে সব পণ্যের পেছনে খরচ হয়, সেই খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য
অত্যাবশ্যক পণ্যে সামান্য মূল্যবৃদ্ধিও তাদের পক্ষে সমস্যাজনক। মূল্যবৃদ্ধি
ঘটে প্রধানত খাদ্য ও জ্বালানির ক্ষেত্রে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে।
দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগোষ্ঠীর কথা যদি বাদও দেই, বাংলাদেশের বেশির
ভাগ মানুষই আসলে দরিদ্র। তাই মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয়বৃদ্ধির কোনো
উপায় তাদের নেই। ফলে, অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই মূল্যবৃদ্ধি খুবই
কষ্টদায়ক।
সঞ্চয়ী
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ সঞ্চয় করতে চায় নিজের স্বার্থেই। যেহেতু
রাষ্ট্র কল্যাণধর্মী নয়, তাই সে নিজেই ভবিষ্যৎ জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে
আয় থেকে সঞ্চয় করে। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পক্ষে সঞ্চয়
করাটা সম্ভব হচ্ছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি স্বল্প
আয়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহ কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলেছে। মৌলিক
ব্যয় মিটিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে মানুষ প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে।
মানুষ হারাচ্ছে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যেও চলছে মন্দা। মধ্যবিত্ত পরিণত হচ্ছে
নিম্নমধ্যবিত্তে, নিম্নমধ্যবিত্ত চলে যাচ্ছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। এ
অবস্থায় সঞ্চয়ের ভাবনা আসছে না মানুষের মনে।
মূল্যবৃদ্ধি
নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পথ আছে। জ্বালানি তেলের দাম বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে
এখন কমিয়ে এনে; ন্যায্য মূল্যের দোকানের মাধ্যমে জনসাধারণকে খাদ্যশস্য
এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরকার নির্ধারিত দামে দিয়ে; বেসরকারি
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট খরচ নিয়ন্ত্রণ করে; বিভিন্ন
অত্যাবশ্যক পণ্য এবং ওষুধের ওপরে ভর্তুকি দিয়ে; মজুতদারি ও বাজার কারসাজির
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে করে এটি করা যায়। সরকার যদি সেটা করতে পারে
তবেই মানুষ সঞ্চয়ী হতে সচেষ্ট হবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন