এদেশের
মানুষকে সংবাদ বা খবর শুনতে অভ্যস্ত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে বিবিসি
বাংলা; এ কথা দ্বিধা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়,
বাংলাদেশের মানুষকে খবর শুনতে শিখেয়েছে বিবিসি নামের এই আন্তর্জাতিক
গণমাধ্যমটি। শুধু বাংলাদেশের নয় বিশ্বের বেশ কিছু দেশের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ
প্রাপ্তির এক সময়ের নির্ভরযোগ্য উৎস ছিল বিবিসি। প্রায় ৪০টিরও বেশি দেশের
বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের জন্য বিবিসি পরম নিষ্ঠার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশ
করছে। সেই সব দেশের মানুষের কাছে আস্থা ও পরম নির্ভরতার গণমাধ্যম হিসেবে
জায়গা করে নিয়েছে এই গণমাধ্যমটি। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের
সময় এদেশের মানুষের কাছে বিবিসি বাংলা মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে
আর্ভিভূত হয়েছিল।
সেই
সত্তরের দশকে তথ্য প্রযুক্তি বিকশিত না হওয়ার পৃথিবীতে বিবিসি সঠিক সংবাদ
পরিবেশন করে স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে কান্ডারির ভূমিকা পালন করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের
সময়ে রণাঙ্গনের সঠিক খবর তুলে ধরে মুক্তিযোদ্ধা ও এই দেশের সাধারণ মানুষকে
উৎসাহ জুগিয়েছে। সে সময়ে যাদের বাড়িতে রেডিও ছিল না, তারা বিভিন্ন স্থানে
জমায়েত হয়ে দলব্ধভাবে বিবিসির সাংবাদ শুনেছেন। এভাবে মানুষ জমায়েত হয়ে খবর
শুনতে শুনতে কোথায়ও কোথায়ও হাট বা বাজারের সৃষ্টি হয়েছে। এখনো দেশের অনেক
জায়গা ‘বিবিসি বাজার’ নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক তথ্য দিয়ে অসামান্য অবদান রেখেছে বিবিসি বাংলা। এ
কারণে মুক্তিযুদ্ধের পরেও এদেশের মানুষের কাছে বিবিসির নাম পরম মমতায় মনের
গহীনে জায়গা করে নিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিবিসির অবদানকে স্বীকার
বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে সম্মনাও জানিয়েছে। বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠান শুধু
বাংলাদেশেই নয়, ভারতেরও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়।
বিবিসি
থেকে বাংলায় সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর। প্রথমে এর
অনুষ্ঠান সাপ্তাহিকভাবে ১৫ মিনিটের ছিল। পরে ১৯৬৫ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে
নিয়মিত সংবাদ সম্প্রচার শুরু হয়। বিবিসি বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠান লন্ডনের
নিউ ব্রডকাস্টিং হাউজের সদর দপ্তর থেকে এফ.এম, মিডিয়াম ওয়েভ ও শর্টওয়েভে
সমগ্র বিশ্বে সম্প্রচারিত হয়। তাছাড়া ঢাকা, দিল্লি ও কোলকাতা ব্যুরো
অফিসে এ বিভাগের সম্প্রচার ত্বরান্বিত করতে অনেক সংবাদকর্মী ও প্রযোজক কাজ
করেন। রেডিও, ইন্টারনেট, ইন্টারনেট রেডিও এবং ভিডিও এ সব মাধ্যমে বিবিসি
বাংলা সম্প্রচারিত হয়।
সপ্তাহে ১৫ মিনিটের রেডিও অনুষ্ঠান দিয়ে যাত্রা শুরু করে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের বাংলা বিভাগ। এখন প্রতিদিন মোট একঘণ্টার সংবাদ ও সাময়িক প্রসঙ্গের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, যেখানে থাকে সংবাদ, নানা ধরনের ম্যাগাজিন, শ্রোতাদের চিঠিপত্রের আয়োজন এবং লাইভ ফোন-ইন অনুষ্ঠান।
বিশ্বজুড়ে
তথ্যপ্রযুক্তির প্রাসারের কারণে অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো বিবিসির রেডিও
অনুষ্ঠানেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে অনেক আগে থেকেই। বিভিন্ন কারণে অনেক
গণমাধ্যম তাদের গতিপথ পরিবর্তন করেছে। এরই পথ ধরে অর্থ বাঁচাতে ১০টি ভাষার
রেডিও সার্ভিস বন্ধ করতে যাচ্ছে বিবিসি। এর মধ্যে রয়েছে বাংলা সার্ভিসও।
এছাড়া বাংলা ইউনিটের কার্যক্রম লন্ডন থেকে সরিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসার প্রস্তাবও
করা হয়েছে। বিবিসি বাংলা রেডিও সার্ভিস ৮০ বছরেরও বেশি সময় চলার পর অবশেষে
বন্ধ হতে যাচ্ছে। এই খবরটি সত্যিই থমকে দেওয়ার মতো।
এ
ছাড়া খরচ কমাতে কিছু ইউনিটকে লন্ডন থেকে সরিয়ে নিজ দেশে পাঠানোর প্রস্তাবও
করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিবিসি বাংলা সার্ভিসের পরিষেবা ঢাকায়, থাই
পরিষেবা ব্যাংককে, কোরিয়ান পরিষেবা সিউলে এবং ফোকাস অন আফ্রিকা টিভি
বুলেটিন নাইরোবি থেকে সম্প্রচার করা হবে।
রেডিওতে
বাংলা ছাড়া সম্প্রচার বন্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে আরবি, ফার্সি, কিরগিজ,
উজবেক, হিন্দি, বাংলা, চীনা, ইন্দোনেশিয়ান, তামিল ও উর্দু রেডিওর। ফলে
এসব পরিষেবায় কর্মরত ৩৮২ জন চাকরি হারাতে যাচ্ছেন।
বিবিসির
পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বাড়তে থাকা খরচ ও লাইসেন্স ফির
নিষ্পত্তির কারণে সংবাদমাধ্যমটিকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে যেতে হচ্ছে।
বিবিসির পরিষেবাগুলোতে ব্যয় হওয়া ৫০০ মিলিয়ন পাউন্ড থেকে ২৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন
পাউন্ড বাঁচিয়ে পুনরায় অন্য খাতে বিনিয়োগ করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। বিবিসির
রেডিও অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে-এই খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই
বিবিসিপ্রেমী মানুষের মনে বিষাদের ছোঁয়া লেগেছে।
আমিও
ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ পেয়েছি বিবিসি রেডিও অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর
শুনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিবিসির অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিমত লক্ষ করা গেছে। সবার একটিই বক্তব্য, বিবিসি বন্ধ
হয়ে যাচ্ছে; এটি কিছুতেই কেউ মেনে নিতে পারছেন না।
বিবিসি
নিয়ে তাদের আবেগ অনুভূতি সমুদ্র সমান। অসংখ্য শ্রোতা বিবিসিকে চিঠি ও
ই-মেইল লিখে তাদের প্রিয় বিবিসি বন্ধের খবরে মনের হাহাকারের কথা আকুতির
বার্তা জানিয়েছেন। বিবিসি কি লক্ষ-কোটি শ্রোতার প্রিয় বিবিসি বাংলার রেডিও
অনুষ্ঠান প্রচার অব্যাহত রাখবে! আমারও যে চাওয়া এই অনুষ্ঠানটির প্রচার
অব্যাহত থাকুক।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক