ধারাবাহিক
সাত
আজফর আলী গফরগাঁও যাবেন বলে তৈয়ার হয়ে বসে আছেন। নাতনী তার হাত ধরে বসে আছে। এখন সে বড় হয়েছে। আগে সে বাবার কাছে জানতে চাইত দাদু কোথায় যায়? আজ সে দাদুকে বলেছে, আমিও তোমার সাথে যাব। তোমাকে একা একা যেতে দেব না। তারপর বাবাকে বলেছে, আমি দাদুর সাথে যাব, দাদুনির সাথে থাকব। আজফর আলী নাতনীর মাথায় বিলি কাটে। হেসে বলে, বড় হলে যাবে দাদু ভাই।
-তুমি আরও বড় হও। তখন আমাকে নিয়ে তুমি বেড়াতে যাবে।
আমি বড় হয়েছি দাদুনি। আমাকেও সাথে নিয়ে চল। উলফাত গু ধরে। তাকে শান্ত করতে গিয়ে সময় বয়ে যায়। উলফাতকে শান্ত করা যায় না। মা টেনে ভেতরের রুমে নিয়ে যায়।
নাফিসের গাড়িতে করেই যাবেন আজফর আলী। আর ফিরবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন। আরও কিছু জিনিস নিয়ে যাওয়া দরকার ছিল। গিয়ে কিছু কিনতে হবে। গ্রামে যা জমিজমা আছে তা দিয়ে ভালই চলে যেত একজন মানুষের। পুকুর, ছাড়াবাড়ি, জমিজমা পড়ে আছে। ছোটভাই আজগরের মেয় ফুলবানু টুকটাক করে খায়। বাড়িতে গেলে ও জেঠাকে ভালই যত্ন করে। চলার জন্য ছেলের কাছে সাহয্যের হাত পাতার দরকার ছিল না। কিন্তু আজফর আলী অচল। এটাই হলো সমস্যা। মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। ভরা যৗবনের জোয়ার ভাটার দিনগুলো। বিয়ে করে সংসার শুরু করলেন। এর দুই বছর পর ঘর আলো করে নাফিস আসল। বছর কয়েক পর কাকলীর জন্ম হলো। সেই সময়টা কত সুখেই না কাটত। কি সোনালী দিন ছিল সেইসব দিনগুলো। নাফিস পড়াশোনার জন্য একদিন বাড়ি ছাড়ল। মানুষের মতো মানুষ হলো। সরকারী ব্যাংকের একটি ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজার এখন। সামনে আরও প্রমোশন হবে। আরও বড় অফিসার হবে। আরও আরও বড় হোক ছেলে। আরও বড় অফিসার হোক। গর্বে বুকটা ফুলে উঠে আজফর আলীর। আজফর আলীর ছেলে মস্ত বড় অফিসার।
প্রথমে গিয়েই লুৎফার কাছে যেতে হবে। তারপর গিয়ে দাঁড়াতে হবে মায়ের কবরের সামনে। জিজ্ঞাসা করতে হবে কেমন আছ মাইও? আমি যে তোমাকে ভুলে গেছি এ নিয়ে ক্ষোভ কর না। মাফ করে দিও। তোমার দূরন্ত আজফর এখন অচল পয়সা। তোমার আঁচলের ছায়াটা ছাড়া আর কিছু ঠিক মতো চোখে দেখে না। আম্মার কবরের পাশে আব্বার কবর। তারপাশেই দাদা-দাদীর কবর। তাদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে হাত তুলে দোয়া করবেন আজফর আলী। সমস্ত কুল কায়েনাত মখলুকাতের রহমতের জন্য কেঁদে-কেটে একাকার হবেন। তারপর যদি তার মনটা হালকা হয়। তিনি যেন বহুদিন পর একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারেন। বহুদিন তার চোখে ঘুম নেই। ঘুমের ওষুধেও আজকাল আর কাজ হয় না।
আজফর আলী গাড়ির সামনের সিটে বসে তার কালো চশমাটা খুঁজেন। তার চোখে পানি। নাফিস ববাকে চশমাটা পরিয়ে দেয়। ফিসফিস করে বলে, বাবা গফরগাঁওয়ে তুমি থাকতে পারবা না। কষ্ট হলেও এখানে এসেই থাক। আমি কয়দিন পর আবার গাড়ি পাঠিয়ে দেব। পরের মেয়ে কি বলে তা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিবা- কতবার বলেছি তোমাকে। আজফর আলী কোনো কথা বলে না। কিছুক্ষণ ছেলের হাতটা নিজের বুকের কাছে ধরে রাখে। হাবাগুবা ছেলেটার জন্য তার বড্ড মায়া হয়। আদরের ধন সুখে থাকুক, এই কামনায় আবার আসমানে মুখ তুলে।
চলবে...