২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার



তাহিরপুরের ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে যত অভিযোগ

তানভীর আহমেদ, তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) || ০৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩, ০৩:০২ পিএম
তাহিরপুরের ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে যত অভিযোগ


সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়রা বলছেন, বাঁধের পাশ থেকেই বালু কাটা হচ্ছে। সেই বালুই ফেলা হচ্ছে বাঁধে। কৃষকরা বলছেন, সময়মতো গঠন করা হয়নি Project Implementation Committee বা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ( পিআইসি)। ফলে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মানে কোনো নিয়ম মান হচ্ছে না বলেও স্থানীয়রা অভিযোগ তুলেছেন। 

উপজেলার বেশ কয়েকটি প্রকল্প সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার অধিকাংশ প্রকল্পে কাজ শুরু হয়নি।  এলোমেলোভাবে ফেলে রাখা হয়েছে মাটি। মাটি ভরাটের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে মাটিকাটার মেশিন মালিকদের। তারা মাটি কেটে বাঁধে দেবেন, এজন্য চুক্তিও হয়েছে পিআইসির সঙ্গে। সে অনুযায়ী কাজও করছেন মাটিকাটার মেশিন মালিকরা। এদিকে, ১১২ প্রকল্পের মধ্যে লাগানো হয়নি কোনো সাইনবোর্ড ও রেজিস্ট্রার দেওয়া হয়নি।

উপজেলার সদর ইউনিয়ন গাজীপুর গ্রাম এলাকার ‘বলদা’ ও ‘মাটিয়ান হাওররক্ষা বাঁধ’ অংশের ৭৫ নম্বর প্রকল্পে বালু মাটি ফেলে বাঁধের কাজ করছে। এই বাঁধে বালু মেশানো মাটি দেওয়া হলেও সেই মাটি-বালু বসানোর জন্য কোনো দুরমুজ করতে দেখা যায়নি। দুরমুজ ছাড়াই তৈরি এই বাঁধ। এই প্রকল্পের বরাদ্দ ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। 

এমন অবস্থা শুধু এই বাঁধেই নয়। একই অবস্থা বিরাজ করছে টাকাটুকিয়া ব্রিজ সংলগ্ন মাটিয়ান হাওর পিআইসি-৭৬-সহ অন্যান্য বাঁধেও। এই বাঁধের কোনো নিয়মের তোয়াক্কাই করছে না। বালু-মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করছে। 

এ বিষয়ে ৭৫ নম্বর পিআইসির সভাপতি মলাই মিয়া ও সদস্য সচিব জামাল মিয়া বলেন, ‘ইউএনওকে বলেই ড্রেজার দিয়ে আমরা কাজ করছি।’ নীতিমালা অনুসারে কাজ হচ্ছে না, এমন অভিযোগে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তারা।

উপজেলার মাটিয়ান হাওর পাড়ের কৃষক ফারুক মিয়া বলেন, ‘ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে বাঁধ নির্মাণকাজ করার কারণে সামান্য পানির চাপে বাঁধে ভেঙে যাবে সহজেই। আর চালু হওয়া বেশিরভাগ পিআইসি নিয়ম মোতাবেক দুরমুজ না করায় বাঁধের শক্তি বাড়বে না। বাঁধ মজবুত থাকবে না। বাঁধের ভেতরে ফাঁকা থেকে যাবে। পানি আসলে সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে চুইয়ে বাঁধ ভেঙে যাবে। শুধু দুরমুজই নয়, নিয়মের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না বাঁধে।’

মাটিয়ান ও শনি হাওর পাড়ের কৃষকেরা বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো’র) ডিজাইন অনুসরণ করা হচ্ছে না। প্রাক্কলন অনুযায়ী ৬ ফুট উচ্চতায় মাটি দেওয়ার পর দুরমুজ করার কথা থাকলেও বাস্তবে ৩-৪ ফুট মাটি ফেলার পরেও তা করা হচ্ছে না। বাঁধের পাশ থেকে মাটি কেটে বাঁধেই যেখানে-সেখানে মাটি ফেলে রাখছে দায়সারাভাবে। এতে বাঁধ ওপরের দিকে ফিটফাট থাকলেও নিচে দুর্বল থেকে যাচ্ছে।’

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বোয়ালমারা, নজরখালি, মহালিয়া, শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, লোভার হাওর, বলদার হাওর, টাংগুয়ার হাওরসহ ছোট বড় ২৩টি হাওরে গত বছরে (২০২১ সাল) ৬৮টি পিআইসি গঠন করা হয়েছে। এতে ৫৩ কিলোমিটার ফসলরক্ষা বাঁধ ও মেরামতে প্রকল্পে প্রাক্কলন ধরা হয়েছিল ১২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

তবে এবছর অনেক পিআইসি বাতিল করা হলেও এবার গত বছরের চেয়ে ৪৫টি পিআইসি বেশি অনুমোদন করা হয়েছে। এবার ১১৩টি পিআইসি অনুমোদন করা হয়েছে। এবার ৮৪.৫০০ কিলোমিটার বাঁধ হবে আর বরাদ্দ ২০ কোটি ৯৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. হাসান-উদ দৌলা বলেন, ‘চলতি মৌসুমে উপজেলার ৭ ইউনিয়নে ১৭ হাজার ৩৯৩ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ৮০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি চাল উৎপাদন হবে। এর মূল্য ২৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকার বেশি।’

হাওর বাঁচা আন্দোলনের তাহিরপুর উপজেলার যুগ্ম আহবায়ক তোজাম্মিল হক নাসরুম বলেন, ‘তালিকা প্রকাশ করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও তথ্য প্রাপ্তির জন্য ওয়েবসাইটে তথ্য প্রকাশের নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। আমরা চাই টেকসই বাঁধ। বাঁধ করতে হলে চাকা মাটি না দিয়ে গুঁড়ো মাটি দিতে হবে। গুঁড়ো মাটি দিলে বাঁধ শক্ত হয়। চাকা মাটি দিয়ে ভালো করে দুরমুজ না করলে নিচের দিকে ফাঁপা থেকে যায়। আর এই ফাঁপা জায়গায় দিয়ে পানি ঢুকে বাঁধে ভেঙে যায়। এবার হাওরের কোনো ক্ষতি হলে এর দায়ভার পানি উন্নয়ন বোর্ডকেই নিতে হবে।’

শনি হাওর পাড়ের কৃষক শফিক মিয়া বলেন, ‘যেভাবে মন চাইছে, সেভাবে কাজ করা হচ্ছে। কোনো তদারকি নেই। একটি প্রকল্পেও ঠিকমতো দুরমুজ দেওয়া হচ্ছে না। লাগানো হয়নি সাইনবোর্ডও।’

তাহিরপুর উপজেলা হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব প্রকৌশলী শওকত উজ্জামান বলেন, ‘এই বিষয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেবো।’

তাহিরপুর উপজেলা হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা বলেন, ‘যে সব পিআইসি নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাকেও এই কাজ কঠোর নজরদারির মধ্যে দিয়ে করার জন্য বলেছি।’

ঢাকা বিজনেস/এনই/



আরো পড়ুন