বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের অন্যতম একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা। যা শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যা নয়, বরং এটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও বড় বাধা সৃষ্টি করে। গত কয়েক দশকে বিশ্বে বাল্যবিবাহের হার কিছুটা কমলেও, বাংলাদেশে এ সমস্যা এখনও প্রচণ্ড আকারে বিদ্যমান।
শনিবার (৮ মার্চ, ২০২৫) আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ইউনিসেফ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও ইউএন উইমেনের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহের দেশের তালিকায় অষ্টম অবস্থানে বাংলাদেশ। আর এশিয়ায় প্রথম। বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর হওয়ার আগে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০-২৪ বছর নারীদের মধ্যে ২৪ শতাংশ নারী ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দেয়। তা ছাড়া ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরী-তরুণী মেয়েদের ২৮ শতাংশ আগের ১২ মাসের মধ্যে তাদের সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। ১৫-১৯ বছর বয়সী বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে মাত্র ৪৭ শতাংশ জেনেবুঝে প্রজনন স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের যে সাতটি দেশে কিশোরী মেয়ে ও তরুণ নারীদের ডিজিটাল দক্ষতার হার ২ শতাংশ বা তারও কম তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।
এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি, এনজিও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের ঘটনা প্রতিদিন ঘটে যাচ্ছে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনার মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলার একটি গ্রামে মাত্র ১৫ বছর বয়সী একটি কিশোরীর বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসন এবং এনজিওদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সেই বিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল। অন্যদিকে, গাইবান্ধা জেলায় মাত্র ১৪ বছর বয়সী একটি কিশোরীর বিয়ে হয় একজন ৩৫ বছর বয়সী পুরুষের সঙ্গে এবং পরে সে গর্ভবতী হয়ে পড়লে তার জীবন বিপন্ন হয়। রাজশাহীতে ১৬ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রীকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়, যদিও সে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিল। এসব ঘটনা শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের সামাজিক চিত্রকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে।
গ্রামীণ অঞ্চলে বাল্যবিবাহের হার বেশি হওয়ার পেছনে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, সামাজিক প্রথা এবং নিরাপত্তাহীনতা প্রধান কারণ হিসেবে উঠে আসে। গ্রামীণ পরিবারগুলো অধিকাংশ সময় দারিদ্র্যের কারণে মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয়। অনেক সময় অশিক্ষা এবং সামাজিক কুসংস্কারের কারণে পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পারে না যে, বাল্যবিবাহের কারণে তাদের মেয়েদের ভবিষ্যত গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অন্যদিকে, শহুরে এলাকায় যদিও বাল্যবিবাহের হার কিছুটা কম, তবুও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে এখনো এই সমস্যা বিদ্যমান। তবে, শহর অঞ্চলের তুলনায় গ্রামে বাল্যবিবাহের ঘটনা অনেক বেশি ঘটছে, যার অন্যতম কারণ হলো সেখানে শিক্ষার প্রাপ্যতা এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার অভাব।
বাল্যবিবাহের ধর্মীয় দিকেও ভুল ব্যাখ্যা অনেক সময় একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মের মূলধারায় বাল্যবিবাহকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে বিয়ের ক্ষেত্রে পরিপক্বতা ও সম্মতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অল্প বয়সে বিয়েকে ধর্মীয় অনুমোদন হিসেবে প্রচার করে থাকে। হিন্দু ধর্মের কন্যাদান প্রথা এবং খ্রিস্টধর্মে বিয়ের জন্য নির্ধারিত বয়সসীমা রয়েছে, যা বাল্যবিবাহকে উৎসাহিত করে না। তেমনি, বৌদ্ধ ধর্মে ধৈর্য এবং শিক্ষা অর্জনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা বাল্যবিবাহের বিরোধী। তবে, এসব ধর্মীয় বিধানগুলোর ভুল ব্যাখ্যা এবং সামাজিক চাপের কারণে অনেক পরিবার মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়।
বাল্যবিবাহের কারণসমূহ আরও গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করলে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে উঠে আসে দারিদ্র্য। দরিদ্র পরিবারগুলো মনে করে, মেয়েকে বিয়ে দিলে তাদের পরিবারে অর্থনৈতিক চাপ কমবে। এছাড়া, নিরাপত্তাহীনতা এবং যৌন হয়রানি, অপহরণের ভয়ের কারণেও অনেক বাবা-মা মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয়। সমাজে মেয়েদের শিক্ষা বা স্বাবলম্বী হওয়ার গুরুত্ব অনেক সময় ভুল বুঝে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আইনের দুর্বল প্রয়োগও একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। যদিও বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ রোধে আইন রয়েছে, তবে তা সব জায়গায় কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয় না।
এছাড়া স্বাস্থ্যগত দিক থেকে বাল্যবিবাহের প্রভাব ভয়াবহ। বাল্যবিবাহের ফলে অল্প বয়সে গর্ভধারণ করলে মা ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। পুষ্টিহীনতা এবং অপুষ্টি শিশুর স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। শিক্ষাগত দিক থেকে, বাল্যবিবাহের কারণে অনেক মেয়েকে স্কুল ছাড়তে হয়, যার ফলে তাদের ভবিষ্যত সঙ্কটে পড়ে। অনেক মেয়েই উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারে না, যা তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমিয়ে দেয় এবং দারিদ্র্যের চক্রে আটকে রাখে। এছাড়া, বাল্যবিবাহের ফলে পারিবারিক নির্যাতন, মানসিক চাপ, হতাশা এবং সহিংসতার হার বৃদ্ধি পায়, যা সমাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদী বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করে, যেখানে মেয়েদের জন্য বিয়ের বয়স ১৮ এবং ছেলেদের জন্য ২১ বছর নির্ধারণ করা হয়। এই আইনে বাল্যবিবাহের অপরাধে জড়িতদের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু অনেক সময় আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না।
এছাড়া, বাল্যবিবাহ কমাতে এনজিওগুলোও বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালাচ্ছে, যেমন ব্র্যাকের ‘অডোলেসেন্ট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের ‘Girls Not Brides’ আন্দোলন। এসব কার্যক্রম বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাল্যবিবাহ রোধে বেশ কিছু সফল উদাহরণ রয়েছে। মালাউই, নেপাল এবং ব্রাজিলের মতো দেশগুলো আইন ও সামাজিক প্রচারণার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ কমাতে সফল হয়েছে। মালাউই সরকার ২০১৫ সালে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করে এবং রেডিও ও টেলিভিশন মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করেছে। নেপাল সরকার মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করে বাল্যবিবাহের হার কমিয়েছে, এবং ব্রাজিল কিশোরী মায়েদের জন্য সমর্থন কর্মসূচি চালু করেছে। এসব উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে।
পাশাপাশি বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ রোধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
প্রথমত, আইনি ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ২০১৭ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হলেও, আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব রয়েছে। এই আইনের বাস্তবায়ন জোরদার করতে হবে এবং বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা না পাওয়ার কারণে অনেক মেয়েই বাল্যবিবাহের শিকার হয়। এ জন্য সরকার এবং এনজিওগুলোর প্রচেষ্টায় মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা, শিক্ষা সামগ্রী সরবরাহ, এবং তাদের শিক্ষা চালিয়ে যেতে প্রণোদনা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তৃতীয়ত, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানা সামাজিক প্রচারণা এবং ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে বাল্যবিবাহ শুধু একজন শিশুর জীবনই নষ্ট করে না, বরং তা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এর পাশাপাশি, ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং তাদের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক নিয়ে মানুষকে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে।
চতুর্থত, দরিদ্র পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা অর্থনৈতিক কারণে মেয়েদের বিয়ে না দেয়। সরকার এবং এনজিওগুলোকে একযোগভাবে দরিদ্র পরিবারের জন্য সহায়তা কর্মসূচি চালাতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, বাল্যবিবাহ একটি বৃহৎ সামাজিক সমস্যা যা বাংলাদেশের সমাজ ও দেশের জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। যদিও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তবুও সরকার, বেসরকারি সংস্থা, অভিভাবক এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। যদি আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করি, তবে একদিন বাংলাদেশকে বাল্যবিবাহমুক্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।
লেখক: কবি ও গণমাধ্যমকর্মী। mdsantosazedur@gmail.com