প্রচুর গাছপালায় পরিপূর্ণ কোলাহলমুক্ত শহর। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মধ্যে সবার আগে একটি জেলখানা, রাজধানী থেকে অনেকটা দূরে বিশেষ কায়দায় এই জেলখানাটি তৈরি করা হয়েছে একপাশে নদী ও পাহাড় একপাশে হাইওয়ে রোড রেখে। জেলখানার আসেপাশে তেমন কোনো স্থাপনা করতে দেওয়া হয় না বিশেষভাবে কারাগারের গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য।
ক্যান্টনমেন্টের একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজে একসঙ্গে পড়াশোনা করতো নীতেশ ও আশফাক । নীতেশের বাবা বড় সামরিক কর্মকর্তা, অপরদিকে দরিদ্র্য পরিবারের সন্তান আশফাক। মেধায় দুজনের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি লড়াই হয়, যা অন্যদের মধ্যে আলোচনার তৈরি করে। বরাবরই প্রথম হয় আশফাক, আশফাকের মেধার কাছেই শুধু হেরে যেতে হয়, সহজ স্বীকারোক্তি বন্ধু নীতেশের। নীতেশের বাড়িতে বড় বড় আয়োজন হতো, অনেক সামরিক লোকজন থাকতো সে অনুষ্ঠানগুলোতে, অনেকটা জোর করে আশফাককে নিয়ে যেতো নীতেশ। আশফাকের সেনাবাহিনীতে ঢোকার ইচ্ছেটা মূলত নীতেশের বাড়িতে যাতায়াতের কারণেই তৈরি হয় ছোটবেলা থেকেই। আশফাকের বাবা রাস্তার পাশে ভাতের হোটেল চালায়, সমাজের নিম্নস্তরের মানুষজনই সেখানে আসে। হোটেলের খাবার তৈরির কাজ আশফাককেও করতে হয় বাবা-মায়ে সঙ্গে। বিকেলে নাস্তা তৈরি ও বিক্রির সময় দোকানে সময় দিতে হয় তার বাবার সঙ্গে। কী একটা আন্তঃজেলা ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় আশফাক প্রথম হয়। সেই প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে নীতেশের বাবা প্রধান অতিথি ছিলেন। সেখান থেকেই আশফাকের দারিদ্র্য জীবনের গল্পের সঙ্গে মেধাবী জীবনের সমন্বয় সামরিক কর্মকর্তাকে মুগ্ধ করে। সুযোগ করে দেন ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে পড়ার। সেখান থেকে নীতেশের সঙ্গে পরিচয়, ছেলে দুজন একই স্কুলের একই বয়সী৷ ক্লাসে তেমনটা মিশতো না আশফাক কারও সঙ্গে অনেকটা অভাবী হওয়ার দরুন সংকোচে থাকতো। সবাই প্রায় একই ধরনের ড্রেসআপে থাকতো, বেশিরভাগই আসতো নিজস্ব গাড়িতে, সেখানে প্রথম বছরের পরের দুবছর আর নতুন জামা কাপড় কিনতে পারেনি আশফাক। এই ছেলেটা স্কুলে আসার পর থেকে স্কুলের মান নষ্ট হয়ে গেছে বলে অনেকেই বলাবলি করতো! নিতেশ একবার নতুন ড্রেস নিয়ে এলো বাসায় কিন্তু আশফাক নিতে চায়নি সেই উপহার। নতুন ড্রেস বাসায় থেকেও পুরনো ড্রেসে স্কুলে আসা দেখে নীতেশ বুঝতে পারলো গরিব হলেও আশফাকের আত্মসম্মানবোধ প্রচণ্ড। কোনো কথা না বলেই আসফাকের কাধে মাথা রেখে কেঁদে গেলো কিছুক্ষণ নীতেশ!
বোর্ডের মেধাতালিকায় তৃতীয় হওয়ায় আশফাকের বাড়ির চারদিকে আনন্দ ওড়াউড়ি করতো, যেখানে সন্ধ্যা হলেই জীর্ণ ঘরের চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে যেতো। অন্ধকারের মাঝেই আশফাকের বাবার হাসিমুখ যেন আলোকিত করতো পুরো তল্লাটে। তবে আশফাকের বাবার ধারণা তারচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন সেই উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা। স্কুল পাস করে কলেজে ভর্তির জন্য দেশের সেরা কলেজে জায়গা হয় আশফাকের। অনেকটা ইচ্ছে না থাকলেও সমাজের বিভিন্ন মানুষের অনুরোধ বা চাপে তাকে সে কলেজে ভর্তি হতে হয়। ছিন্ন হয় নীতেশের সঙ্গে একসঙ্গে লেখাপড়া করার সুযোগ।
নতুন কলেজ তারপর তার বাবার সুপ্ত স্বপ্ন সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়া। দক্ষতা ও মেধার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকা।
রঙিন জীবনে হঠাৎ কালো মেঘের ছায়া। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে, হয়ে যায় কারাবন্দি। প্রচণ্ড আত্মমর্যাদা সম্পন্ন আশফাক কোনো কারণে হয়তো দফারফা করতে পারেনি। লাগিয়ে দেওয়া হয় দুর্ধর্ষ অপরাধীর প্রলেপ। জেল থেকে জেলে চলতে থাকে তার কারাজীবন। শেষ পর্যন্ত তার গন্তব্য হয় সেই শহরের সেই বিশেষ নিরাপত্তায় রাখা জেলখানায়। দীর্ঘদিনের কারা নির্যাতনে ততদিনে প্রায় নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে আশফাক। খুব ইচ্ছে ছিলো তার বাবা-মা কেমন আছে কোথায় আছে জানার। সে সময় দাগী আসামিদের মতো রাখা হতো আলাদা কামরায়। দেওয়া হতো না সাধারণ কয়েদিদের মতো স্বাভাবিক খাবার পর্যন্ত। স্বয়ং জেল প্রধান মাঝে মাঝে নিজ হাতে নির্যাতন করে ওপরে রিপোর্ট পাঠাতেন তার দায়িত্বশীল কাজের!
হটাৎ একদিন সেনাসদরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা পরিদর্শনে যাবেন সেই কারাগারে। গতানুগতিক শাস্তি স্বরূপ তাকেসহ আরও দাগি কয়েদিদের দিয়ে কারাগারের ময়লা আবর্জনা সাফ করানো হয়। জেলখানা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে নতুন সাজে সাজানো হয় পরিদর্শককে খুশি করার জন্য। দাগি কয়েদিদের দেওয়া হয় নতুন সাদা কালো ডোরা কাটা কারা পোশাক। আশফাকের সেলটা অনেকটা হাইওয়ে রোডের কাছাকাছি ছিল। প্রটোকলের গাড়ির হর্ন বাজানো গাড়িগুলো একে একে জেলখানার সামনে এসে থামলো। ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে পড়াশোনা ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাশেই বসবাসের সুযোগে আশফাক প্রটকল হর্নগুলোতে বুঝতে পারে পরিদর্শক একজন সেনা কর্মকর্তা। সুনসান নীরবতা ভেদ করে পরিদর্শক সাহেব বিভিন্ন সেলগুলোতে যাচ্ছেন। বন্দিদের সঙ্গে কথা বলছেন। বিশেষ করে যাবজ্জীবন ও মৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সঙ্গে একাকীও কিছু কথা বলছেন। সেনাকর্মকর্তা মূলত বর্তমানে গোয়েন্দা সংস্থার একটি বিশেষ দায়িত্বে আছেন। মৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামিকে প্রশ্ন করলেন যে অপরাধের জন্য আপনার মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে, আপনাকে যদি দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়া হতো আপনি ওই একই পরিস্থিতিতে কী করতেন? বা সেই অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য ওই সময়টাতে ভিকটিমকে হত্যা না করে বিকল্প কী ব্যবস্থা নিতেন? আসামি মুখের কোনোরূপ পরিবর্তন না করেই বলে, আরও নৃশংসভাবে হত্যা করতাম, যাতে এই খবর দেশের সঙ্গে দেশের বাইরেও পৌঁছে যেতো! গোয়েন্দা কর্মকর্তা বুঝলেন তার মধ্যে এখনো বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। মূলত এই সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তা দেশে অপরাধ প্রবণতা কমানোর জন্য গবেষণা করেন। বিভিন্ন আসামির সঙ্গে কথা বলে ঘটনার সময়কাল বুঝতে চেষ্টা করেন। বিভিন্ন সেমিনারে সেগুলো জনসাধারণের ওপর ইমপ্লিমেন্ট করার চেষ্টা করেন। জেল প্রধান পাশ থেকে বলে ওঠেন, স্যার বাদ দেন পাগল হয়ে গেছে ওর মাথা ঠিক নাই। পরেরটায় কি আর যাবেন না কি লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছি ওখানে যাবেন স্যার?
দীর্ঘ রাস্তা জার্নি ও অনেক কয়েদির সঙ্গে কথা বলে অবশ্য পরিদর্শক সাহেব অনেকটা ক্লান্ত। ফিরে যাওয়ার মনস্থ করলেও দূর থেকে তার চোখ পড়ে একটি সেলে একটি আসামি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
পরিদর্শক একটু এগিয়ে যাবেন বুঝতে পেরে জেলা প্রধান বলে উঠলেন, স্যার ওইদিকে যাইয়েন না আপনার ইজ্জত থাকবো না! কেন? উত্তরে বলে উঠলেন, উনিও একজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। এহন দাগি কয়েদি। আপনাগো সেনাবাহিনীর ইজ্জত এক্কারে শেষ কইরা দিছে লোকটা। কৌতূহলী সেনা পরিদর্শক এগিয়ে গেলেন অনেকটা দ্রুত গতিতে, সেলের দরজা খুলে দিতেই প্রবেশ করতেই কয়েদিকে কেমন যেন পরিচিত মনে হলো পরিদর্শকের। কেমন যেন কতদিনের পরিচয় অথচ মেলাতে পারছেন না। এর আগে কখনো কোন আসামিকে তার এত পরিচিত মনে হয়নি। বিশেষ করে কয়েদির চোখের জোড়া ভ্রূ দেখে পরিচিতির মাত্রাটা যেন বেশি চেপে বসেছিল। চেয়ারে বসতে বসতে পরিদর্শক নাম জিজ্ঞাসা করলেন। কয়েদির নিরুত্তর ভঙ্গি বুঝে জেল প্রধান তার সহযোগীকে বলে উঠলেন, কী নাম জানি রে এটার? সহযোগী উত্তরে বললেন, আশফাক রায়হান।
সাইবেরিয়া যুদ্ধে শান্তি মিশনে থাকা অবস্থায় পরিদর্শকের একবার একটা গুলি লেগেছিল বাম হাতে। সেই গুলির আঘাতের তাৎক্ষণিক যে ব্যথা হয়েছিল, আশফাক রায়হান নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তারচেয়ে বড় আঘাত যেন তার বুকের মধ্যে এসে লাগলো। চেয়ারে সম্পূর্ণ বসার আগেই নামের আঘাতে আর বসতে পারলেন না! উঠে দাঁড়িয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কী বললে? কী নাম? এবার জেল প্রধান বললেন, ‘আশফাক। স্যার, আশফাক নামটা মনে পড়ছে। একইসঙ্গে পরিদর্শকের মনে পড়ে গেলো তার ছোট বেলার বন্ধু আসফাকের কথা। পরিচিত জোড়া ভ্রূওয়ালা মুখটা তার সেই ছোট বেলার বন্ধু আশফাক নয়তো? এত মানুষের ভিড়ে পরিদর্শক বলতে পারছে না, আমার নাম নীতেশ। তুই আমার সেই বন্ধু আশফাক নয়তো? আশফাকে কাছে গিয়ে খুব ভালো করে মনে করার চেষ্টা করছে ২৬ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বন্ধু আশফাক নয়তো? হাত ও পায়ের কিছু নখহীন আঙুলের দিকে চোখ পড়তেই বুঝলেন কী নির্মম অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে তাকে এই বন্দিজীবনে। আশফাকের চোখের দিকে তাকিয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে চারদিকের নীরবতায় যেন কত চিৎকার শুনতে পাচ্ছেন পরিদর্শক নীতেশ। নিজের পায়ের বৃদ্ধাআঙলটা বারবার মাটিতে চেপে ধরে আশফাক ভাবছে পরিদর্শক তার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন? পরিদর্শকের চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে কেন? অসংখ্য প্রশ্নে মাথায় ঘুরছে অথচ কেউ কাউকে কোনো প্রশ্ন করতে পারছে না! নিজের ঘোলা হতে যাওয়া দৃষ্টিতে আশফাককে ঘোলা হতে যাওয়া চোখগুলো একটু পড়পড় আবার ভালো করে দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নীতেশ। উড়ন্ত গ্রেনেড নিজের দিকে আসতে দেখলে যেমন প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় বুকের মধ্যে চাপা অনুভূতি হয়, তারচেয়ে বেশি চাপ অনুভব করছেন নীতেশ। আশফাককে কোনো প্রশ্ন না করে জেল প্রধানকে হুকুম দিলেন তার ফাইলটা নিয়ে আসার জন্য। জেল প্রধান বুঝতে পারলেন তিনি এখানে কিছু সময় নেবেন। পরিদর্শকের ভাবভঙ্গি দেখে সঙ্গে থাকা সব লোকজনকে বের করে দিলেন সেল থেকে। প্রফাইলের কভার উল্টাতেই তরুণ আশফাকের সেনা পোশাক পরিহিত ছবি দেখে আরও কাছাকাছি পৌঁছালো আশফাককে খুঁজে পাওয়ার। নিজের স্কুলের নাম দেখে নীতেশ নিশ্চিত হয় এটাই তার ছোট বেলার বন্ধু আশফাক। আশফাককে এভাবে খুঁজে পাবে কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি নীতেশ। পুনরায় আশফাকের দিকে তাকাতেই নীতেশের মনে হলো, আশফাকের চোখর দৃষ্টি যেন যুদ্ধাস্ত্রের বুলেট নিক্ষেপ করছে নীতেশের বুকে। হাউমাউ করে কাঁদতে পারলে মনের যন্ত্রণাটা কিছুটা কমতো মনে হচ্ছে। যুদ্ধে প্রতিপক্ষের কাছে ধরা খেলে যেমন উৎকণ্ঠার অনুভূতি তারচেয়েও ক্ষিপ্র অনুভূতি হচ্ছে নীতেশের। ছটফট করতে থাকা পরিদর্শককে দেখে প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছেন না জেল প্রধান। ততক্ষণে আশফাকের চোখ থেকেও পানি ঝরছে কিন্তু কোনো কারণ ছাড়া!
আশফাককে কোনো প্রশ্ন করতে পারলেন না নীতেশ। জেল প্রধানকে বললেন, তার বিরুদ্ধে এত মামলা কেন, কিছু জানেন? উত্তরে স্বগৌরবে জেল প্রধান বললেন, স্যার সরকারবিরোধী অনেক কর্মকাণ্ড তার। নানান অপরাধের সাথে জড়িত। পরবর্তী কোনো প্রশ্ন না করে সেল থেকে বের হয়ে গেলেন পরিদর্শক। জেল প্রধানের রুমে গিয়ে বসলেন৷ দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করার জন্য অনুমতি চাইলেন জেল প্রধান। সামনে সাজানো বিভিন্ন বাহারি খাবার। জেল প্রধান বললেন, স্যার এগুলো সব আমার জেলেই উৎপাদিত। এখানেই কয়েদিরা কাজ করে বানাইছে স্যার। একদম টাটকা। অন্যদিকে জেল ক্যন্টিনের খাবার থেকে আশফাক বঞ্চিত হয়েছিলেন বহু আগেই।
বাহারি খাবার আর খেতে পারলেন না নীতেশ। আশফাকের প্রোফাইলে পাতার পর পাতা উল্টাচ্ছেন। সাইবেরিয়ায় যেবার মিশনে ছিলেন নীতেশ তার ২ বছর আগে আফ্রিকায় কঠিন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল আশফাক, অনেক অর্জন তার দেখতে লাগলেন। কণ্ঠনালী কেমন যেন বন্ধ হয়ে আসছে। কখন আশফাককে একা পাবে সেই চিন্তায় নীতেশ। এত মানুষের ভিড়ের মাঝে খেয়াল হারিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন নীতেশ।