চলতি বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জের ১৩৭ হাওরে ধুম লেগেছে ধানকাটার। জেলার বিভিন্ন হাওরে পাকা ধান কাটছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ কাটা ধান মাড়াই করছেন, অনেকে শুকাচ্ছেন। অনেকে বাতাসে ধানের চিটা ছাড়াচ্ছেন। তৈরি করছেন ধানখলা (ধান মাড়াই ও ধান শুকানোর স্থান) ও খলাঘর। অনেকে গোখাদ্য হিসেবে খড়ও শুকাচ্ছেন। ধানখলায় নারীরা কাজ করছেন। ধীরে ধীরে বোরোধান নিয়ে ব্যস্ততা বেড়েছে হাওরে। চাষিদের চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক ভাসছে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই সময়টায় সুনামগঞ্জে ও জেলার উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে অতিবৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। উজানে ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নেমে আগাম বন্যা দেখা দেয় হাওরে। ভারী বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে কিংবা বাঁধ উপচে হাওরের ফসল তলিয়ে ফেলে।
এবারও মার্চের শেষ সপ্তাহ এবং এপ্রিলের শুরুতে ব্যাপক ঝড়বৃষ্টি হওয়ায় সবার মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল। বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে কয়েকটি হাওরে বেশ কিছু ধান নিমজ্জিত হয়েছে। এতে ওই সব জমির কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কিন্তু গত তিন দিন বৃষ্টি না হওয়ায় তাদের মনে স্বস্তি ফিরেছে। হাওরে এখন পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে। তবে এবার হাওরে বৃষ্টির পানি থাকায় মেশিন দিয়ে ধান কাটাতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ১৩৭টি ছোটবড় হাওরে বোরোচাষে জড়িত প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার চাষি পরিবার। এবার হাওরে বোরোচাষ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর। এর মধ্যে ৭০.০৫ ভাগ উফশী (উচ্চ ফলনশীল ধান), ২৯ ভাগ হাইব্রিড ধান ও ০.০৫ ভাগ স্থানীয় প্রজাতির দেশি ধান আবাদ হয়েছে। গতকাল ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত কর্তন হয়েছে প্রায় ২৪ হাজার হেক্টর। যা চাষাবাদের প্রায় সাড়ে ১৭ ভাগ।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে হাওরে ধান কাটতে ৮৭০টি কম্বাইন হার্ভেস্টর ও ২০০টি রিপার যন্ত্রের সঙ্গে রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক। প্রতিদিন গড়ে একটি হার্ভেস্টর ১শ জন শ্রমিকের ও রিপার ২০ জন শ্রমিকের ধান কাটতে পারে। কৃষি বিভাগের মতে হাওরে ১ লাখ ৯০ হাজার নিয়মিত কৃষিশ্রমিক, ৩০ হাজার অনিয়মিত শ্রমিক ও বাইরের জেলার আরও প্রায় ১০ হাজার শ্রমিকসহ প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিকও ধান কাটতে শুরু করেছেন।
কৃষি বিভাগ আরও জানিয়েছে, এবার হাওরে বিআর ২৮, ২৯ বীজ দেওয়া হয়নি সরকারিভাবে। তাই হাওরে ৮৯, ৯৬, ৮৮, ৯২, বঙ্গবন্ধু-১০০ ধানের আবাদ হয়েছে বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন প্রকৃতি এভাবে ১৫দিন অনুকূলে থাকলে হাওরের শতভাগ জমির ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। হাওরের পুরো ধান কৃষক গোলায় তোলতে পারলে গত বারের চেয়ে এবার আরো ১১০ কোটি টাকার বেশি ধান উৎপাদিত হবে। গত বছর ৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৪৯ মে.টন চাল উৎপাদিত হয়েছিল। এবার ৯ লক্ষ ১৩ হাজার মে. টন চাল উৎপাদিত হবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা।
সরেজমিন জেলার বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখা গেছে, পাকা ধান কাটছেন কৃষকরা। অনেকে কাটা ধান মাড়াই করছেন, অনেকে শুকাচ্ছেন। অনেকে বাতাসে ধানের চিটা ছাড়াচ্ছেন। তৈরি করছেন ধানখলা ও খলাঘর। অনেকে গোখাদ্য হিসেবে খড়ও শুকাচ্ছেন। ধানখলায় (ধান শুকানো ও নাড়ার স্থান) নারীরা কাজ করছেন। ধীরে ধীরে বোরোধান নিয়ে ব্যস্ততা বেড়েছে হাওরে। ভেজা ধান ও খড়ের গন্ধ বৈশাখী হাওয়ায় মাদকতা ছড়িয়ে দিয়েছে হাওরে। দেখা গেছে কৃষকরা নারীদের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদেরও নিয়ে এসেছেন। যে কোন মূল্যেই তারা শ্রমঘামে ফলানো একমাত্র ফসল গোলায় তোলতে চান।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওরপাড়ের মুক্তিখলা গ্রামের কৃষক আবদুল গণি বলেন, একসময় হাওরে ধান কাটার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিক আসতেন। এখন এটা একবারে কমে গেছে। স্থানীয়ভাবেও শ্রমিক মেলে না। তাই এখন ধান কাটার যন্ত্রের ওপরই ভরসা। কিন্তু হাওরে পানি থাকলে মেশিনে ধান কাটায় সমস্যা হয়।
দেখার হাওরের জয়কলস গ্রামের কিষাণী মতিমালা বিবি (৬০) তার এক কন্যাকে নিয়ে খলায় ধান শুকাচ্ছে। হাওরের কান্দায় (উঁচু জমিতে) ধান তোলাকে কেন্দ্র করে তৈরি করেছেন অস্থায়ী খুপড়ি ঘর। বৃক্ষহীন গহীন হাওরের মধ্যে রোদ ও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে এই ঘর তৈরি করেন কৃষক। তিনি প্রখর রোদের কারণে ধান শুকাতে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বসে আছেন খুপড়িঘরে।
এই কিষাণী জানালেন, তার ১২০ শতক জমির সবটুকুতেই বিনা-৭৪ লাগিয়েছেন। তবে ধানের ফলন কম হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ শতক কর্তনের পর মাত্র ১২ মণ ধান হয়েছে। তিনি বলেন, ‘৭৪ ধান ছুছা অই গিছে, পুরা মাইর গেছে। অনে ৬ বাচ্চা লইয়া বেউপায় অবস্থা।’
খরচার হাওরের বিশ্বম্ভরপুর গ্রামের কৃষক স্বপন কুমার বর্মণ বলেন, কয়েকদিন আগে টানা বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতায় ধান পাকছে দেরিতে। এ কারণে জমিতে ধানকাটা মেশিন নামানো যায়না। শ্রমিক পেলে ১৫ দিনেই হাওরের ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। তবে এবার বোরো ফসল খুব ভালো হয়েছে বলে জানান তিনি। ধান ওঠলে কৃষকের ঘরে ফিরবে সচ্ছলতা জানালের এই সচ্ছল কৃষক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, আবহাওয়া পুরোপুরি অনুকূলে আছে। তাই ধানকাটা শুরু হয়েছে প্রতিটি হাওরেই। মাত্র ১৫ দিন প্রকৃতি সদয় থাকলে কোনও ফসল অবশিষ্ট থাকবেনা। তিনি বলেন, যথাসময়ে বৃষ্টি পাওয়ায় এবারও বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই গতবারের চেয়ে এবার উৎপাদনমূল্যও বেশি হবে। শ্রমিক সংকট বিষয়ে তিনি বলেন, শ্রমিকের সংকট নেই। যদি কিছু এলাকায় শ্রমিকের সংকট দেখা দেয় তাহলে স্থানীয় প্রশাসনকে অবগত করলে এই সমস্যার সমাধানেরও ব্যবস্থা আছে। ফসল তোলতে কৃষি বিভাগ ও প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্কতায় আছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেছেন, ঝড়বৃষ্টিতে কিছুটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল, সেটা কেটে গেছে। কৃষকেরা যাতে হাওরের ফসল নির্বিঘ্নে গোলায় তুলতে পারেন, এ জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করা হবে।
ঢাকা বিজনেস/এনই