২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার



শিক্ষা কারিকুলাম-২০২৩ নিয়ে কিছু কথা

আবুল কালাম আজাদ || ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০৬:৪২ এএম
শিক্ষা কারিকুলাম-২০২৩ নিয়ে কিছু কথা


ইতোমধ্যে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করেছি। এই অর্ধ শতকে অনেক দিকেই আমাদের উল্লেখযোগ্য অর্জন আছে। তবে জাতির মেরুদণ্ড আমরা সঠিকভাবে মেরামত করতে পারিনি। অর্থাৎ শিক্ষায় আমরা পিছিয়ে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পারিনি, বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আর তা পারিনি বলেই অবকাঠামোগত উন্নতি সত্ত্বেও আমরা উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছি না, অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছি।  

বেশ কয়েকবার আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন আনা হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। মুখস্থ বিদ্যা, নকল প্রবণতা, নোট-গাইড বই ঠেকানোর জন্যই আনা হয়েছিল সৃজনশীল পদ্ধতি। কিন্তু আমরা কী দেখতে পেলাম? বাস্তবে আমরা দেখছি, নোটবই, গাইড বই লুপ্ত তো হয়ইনি; বরং যে নোটবই ছিল ২৫ ফর্মার, এখন তা হয়েছে ৫০ ফর্মার। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে কোচিং সেন্টার। আর অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে গৃহশিক্ষকের রুটিন হয়েছে ক্লাস রুটিনের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকার খবরে দেখলাম বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা কোচিং বাণিজ্যে লেনদেন হয়। এ পর্যন্ত সৃজনশীল পদ্ধতির মূল চেতনাটি শিক্ষার্থীদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। না পারার দায় কেবল এই পদ্ধতির নয়, এ দায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক সমাজের, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের এবং অতি উৎসাহী, অতি যত্নবান অভিভাবকদেরও।

সৃজনশীল পদ্ধতি সফল বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় সৃজনশীল শিক্ষকের অভাব। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা সৃজনশীল শব্দটির সুস্পষ্ট ধারণা ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনেও সমর্থ নন। যিনি নিজে সৃজনশীল নন, তিনি কিভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতার বীজ বপন করবেন! সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষকের একটি গুরুদায়িত্ব সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা। যথার্থ সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষকের সৃজনের সামর্থ্যের ঘাটতি আছে। অধিকাংশ শিক্ষকই প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন নোট ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভর করে। কেউ কেউ কম্পিউটার ফাইলে সংরক্ষিত আগের প্রশ্ন কিছুটা পরিমার্জন ও পরিশোধন করে দায়িত্ব সমাধা করেন। 

এ ছাড়া নোট ও গাইড যাঁরা লেখেন, তাঁরাও তো সবাই যথার্থ সৃজনশীল নন। ফলে এ পদ্ধতি প্রবর্তনের পর থেকে গতানুগতিকতারই চর্বিতচর্বণ চলছে। অতএব, যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তন হয়েছিল তা ব্যর্থ হয়েছে।  

তারপর পিইসি/ইবতেদায়ি ও জেএসসি/জেডিসি ইত্যাদি পরীক্ষা চালু হওয়ার পর শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা মূলত আটকে গিয়েছিল পরীক্ষা আর (এ+)-এর ভেতর। এর বাইরে তারা কিছুই ভাবতে পারছিল না। প্রশ্ন ফাঁস করে হলেও (এ+) পেতে হবে, না হলে মান-সম্মান কিছু থাকবে না। শিক্ষার্থীরা আর শিক্ষার্থী থাকেনি, সবাই হয়ে গিয়েছিল পরীক্ষার্থী। অথচ এসব পরীক্ষা ও (এ+) ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের জীবনে কিভাবে কতটা কার্যকর হবে, সে সম্পর্কে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক কেউই কিছু জানতোও না, ভাবতোও না। তাদের একমাত্র ভাবনা হলো একটা (এ+) পেতে হবে। এর জন্য নোট-গাইড, কোচিং এবং প্রাইভেট টিউটরের পেছনে জলের মতো টাকা ঢালতে অভিভাবকদের কোনো দ্বিধা ছিল না। 

বলা হয়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা ফ্রি অর্থাৎ অবৈতনিক, কিন্তু শিক্ষার পেছনে খরচ হত অঢেল। শুধু পাঠ্য বইটাই শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিনামূল্যে পেতো, শিক্ষাটা নিতে হতো নোট-গাইড, কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট শিক্ষকের কাছ থেকে।

উল্লিখিত বিষয়গুলো মাথায় রেখে শিক্ষা কারিকুলাম ২০২৩ চালু করা হয়েছে। তবে এটা এখনই সব ক্লাসে কার্যকর হবে না। ধাপে ধাপে কার্যকর করা হবে।

বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে ২০২৩ সালের নতুন শিক্ষাক্রম:

১। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন শিক্ষাক্রম ১ম, ২য় ও ৬ষ্ঠ, ৭ম শ্রেণীতে বাস্তবায়ন হচ্ছে।

২। ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ৩য়, ৪র্থ ও ৮ম, ৯ম শ্রেণীতে বাস্তবায়িত হবে।

৩। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ৫ম ও ১০ম শ্রেণীতে বাস্তবায়িত হবে।

৪। ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে শুধু একাদশ শ্রেণীতে বাস্তবায়িত হবে।

৫। ২০২৭ শিক্ষাবর্ষে শুধু দ্বাদশ শ্রেণীতে বাস্তবায়িত হবে।

৬। প্রাক-প্রাথমিক হচ্ছে দুই বছরের, যা ২০২২ পর্যন্ত ছিল এক বছর।

৭। প্রাক-প্রাথমিকে থাকছে না কোনো সরকার নির্ধারিত বই, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই পড়াবেন তাঁদের নিজেদের মতো।

৮। প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত থাকছে না কোনো পরীক্ষা। ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে শ্রেণীতে শেখানোর ওপর ভিত্তি করে হবে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন।

৯। বই থাকছে-প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত ০৩টি। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত অভিন্ন বিষয়ের ০৮টি। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত থাকবে অভিন্ন বিষয়ের মোট ১০টি।

১০। গতানুগতিক পরীক্ষার বাইরে মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন সামষ্টিক উপায়ে।

১১। উঠে যাচ্ছে পিইসি/ইবতেদায়ি ও জেএসসি/জেডিসি নামের পাবলিক পরীক্ষা। তাই আর শিক্ষার্থীদের পোহাতে হবে না এই ঝামেলা।

১২। শিখনকালীন মূল্যায়নের ধরন হচ্ছ এসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ এবং হাতে কলমে।

১৩। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ।

১৪। নবম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ।

১৫। একাদশ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৩০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ।

১৬। এসএসসি পরীক্ষা আর আগের মতো ৯ম-১০ম শ্রেণির বই মিলিয়ে হবে না, শুধু ১০ম শ্রেণীর বই ও সিলেবাস অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে শিক্ষার্থীদের ১ম পাবলিক এই পরীক্ষা।

১৭। মাধ্যমিক পর্যায়ে থাকছে না আর আলাদা আলাদা ৩টি বিভাগ। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা অভিন্ন বিষয় অধ্যায়ন করবে।

১৮। ২০২৩ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ফলে শিক্ষার্থীরা বিভাগ (বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা) পছন্দ করতে পারবে একাদশ শ্রেণীতে।

১৯। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে অনুষ্ঠিত হবে আলাদা ২টি পরীক্ষা; এই দুই শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে রেজাল্ট দেওয়া হবে এইচএসসি পরীক্ষার।

২০। উঠে যাচ্ছে সৃজনশীল ও গ্রেড পদ্ধতি।

২১। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে ০৩টি স্তরে-

প্রথম স্তর : এলিমেন্টারি (প্রাথমিক) লেভেল।

দ্বিতীয় স্তর : মিডেল (মধ্যম) লেভেল।

তৃতীয় স্তর : এক্সপার্ট (পারদর্শী) লেভেল।

অনেকের মতো আমিও মনেকরি, বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম একটি আন্তর্জাতিক মানসম্মত কারিকুলাম, কেরানি হওয়ার শিক্ষা থেকে বেরিয়ে আসার কারিকুলাম, লেখাপড়া শেষ করে আমার সন্তান ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অফিসার হয়ে টাকা কামানোর মেশিন হবে এ ধরনের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার কারিকুলাম। এখন যে শিশু, তার কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে কম করে হলেও ২০/২২ বছর লাগবে। বর্তমান বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব। প্রতিনিয়ত অনেক পেশা ও কর্ম পদ্ধতি বাতিল হয়ে যাচ্ছে, যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন পেশা ও কর্ম পদ্ধতি। আমরা যারা এই শতকের শুরুর দিকে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলাম এখন দেখতে পাচ্ছি তখনকার অনেক পদ-পদবি নেই। নতুন পদ-পদবি সৃষ্টি করে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় সেক্টরেই এটা হচ্ছে। আজ আমরা চিকিৎসা বা প্রকৌশল পেশাকে যেভাবে দেখি ২৫ বছর পর এইসব পেশা যে সেরকমই থাকবে, কর্ম পদ্ধতি যে সেরকমই থাকবে তা বলার কোনো সুযোগ নেই। এসব দিক বিবেচনা করে বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম ঠিকই আছে। কর্তৃপক্ষ দূরদর্শিতার পরিচয় রাখতে পেরেছেন। 

আমাদের দেশে যারা বেকার দেখবেন তাদের সবাই শিক্ষিত। অশিক্ষিত মানুষ কিন্তু বেকার থাকে না। তারা কিছু না কিছু একটা করে। এই যে কিছুদিন আগে এইচএসসির রেজাল্ট হলো সেখানে শুধু (এ+)ই পেয়েছে ৭৮০০০০। এই ৭৮০০০ কি চূড়ান্ত সফল মানুষ হবে? এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো উচ্চ শিক্ষার জন্য কোথাও ভর্তি হওয়ারই সুযোগ পাবে না। তাদের মধ্যে কেউ কি বেকার হবে না? (এ+) এর কম যারা পেয়েছে তাদের কথা ভাবুন। পত্রিকার খবরে দেখলাম, কাঙ্খিত রেজাল্ট না করার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। অথচ কোনো না কোনো দিকে তাদের এমন মেধা ছিল যে তারা (এ+)দেরও অনায়াসে টপকে যেতে পারতো। অথচ তারা (এ+) না পেয়ে পালিয়ে গেল জীবন থেকে। আমি মনেকরি, ১০/১৫  বছর আগেই এই কারিকুলাম করা দরকার ছিল। তাহলে প্রজন্ম বহুমুখি প্রতিভা অর্জন করতে পারতো, সেই সঙ্গে শিল্প-সংস্কৃতি থেকে এভাবে দূরে সরে যেত না। দেশে বেকারত্ব কমত। আমরা পেতাম নানাবিধ সফল মানুষ। 

নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা করছেন। সমালোচনাটা হচ্ছে মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সমালোচনা মন্দ কিছু না। আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমেই অনেক কিছুর ভুল-ত্রুটি বের হয়ে আসে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোটনার চাইতে গুজবটাই বেশি রটে। অনেকে নিজ স্বার্থের দিক বিবেচনা করে গুজব রটায়। শিক্ষকদের ট্রেনিং বিষয়ক কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেগুলো নিয়ে ট্রল হচ্ছে। সেগুলো সত্য, না মিথ্যা, সেসব ভিডিও কারা বানিয়েছেন, কেন বানিয়েছেন এসব না ভেবেই ট্রল হচ্ছে।

গুজবের প্রেক্ষিতে আমি যা বলবো:

১। ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে মোট বিষয় ১০টি। এর মধ্যে একটি হল “জীবন ও জীবিকা”। এই বিষয়ের ৩৬৫ দিনের ক্লাসের মধ্যে মাত্র একদিন রান্না শেখানোর বিষয় রয়েছে। শিক্ষাবিদগণ দেখেছেন যে, একজন মানুষ যদি অন্তত ভাত, ডাল, সবজি, আলুভর্তা, মাছ বা মাংস রান্না করতে পারেন খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বাস্তব জীবনে তিনি কোনো সমস্যায় পড়বেন না। শিক্ষার্থীরা সবাই মিলে একদিন একজন বা দুইজনের খাবার রান্না করতে শিখবে। তবে কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বড় আকারে রান্নার আয়োজন করছে। এর সঙ্গে কারিকুলামের কোনো সম্পর্ক নেই। আর এই ভিডিওগুলো রঙ-তালির ক্যাপসন দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। 

২। কারিকুলাম নিয়ে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার আগে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। পরবর্তী প্রশিক্ষণ ৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়ার কথা। প্রশিক্ষণের কোথাও বা কোনো বইয়ে সাইকেল চালানো, ব্যাঙের মত লাফানো এসব ছিল না। প্রশিক্ষণকালীন একঘেয়েমি দূর করার জন্য ১০/১৫ মিনিটের বিরতী দেয়া হয়। এই সময়ে শিক্ষকদের কেউ কেউ গান গেয়ে, কবিতা আবৃত্তি করে, কৌতুক করে মজা করতে পারেন। আর এসব ভিডিও ধারণ করে কোনো অসৎ ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে কারিকুলামের অংশ হিসাবে দেখিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।

৩। ডিজিটাল ডিভাইস শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়ার কোনো নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের নেই। ডিজিটাল ডিভাইস থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করার বিষয় রয়েছে। যেমন আবহাওয়ার পূর্বাভাস শিক্ষার্থীরা গুগল থেকে জানতে পারে। তবে কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা নেই। আর এসব অভিভাবকের পূর্ণ তত্ত্বাবধানে থাকবে। মনে রাখতে হবে, অভিভাবগণও এই কারিকুলামের একজন অংশীদার। কেউ কেউ বিদেশী ছেলেমেয়েদের এ্যাপস বা ড্রোন বানানোর গল্প করেন। হ্যাঁ, অনেকে অল্প বয়সে এসব বানিয়ে টাকা-নাম দুটোই কামিয়েছে। আমি যদি আমার সন্তানকে ডিজিটাল ডিভাইসের ইতিবাচক ব্যবহার না শেখাই তো তারা পিছিয়ে পড়বে। 

বলেছিলাম যে, অভিভাবকরা আটকে গেছেন পরীক্ষা ও (এ+)-এ। সে কারণেই পরীক্ষা থাকবে না, গ্রেডিং থাকবে না এদিকটা তারা মানতে পারছেন না। যারা এই কারিকুলামের সমালোচনা করছেন তাদের সমস্যা আরও কিছু জায়গায় আছে, যদিও তারা সেটা স্পষ্ট করে বলছেন না। তারা জীবন ও জীবিকা বিষয়টির সমালোচনা করছেন। আমার মনে হয়, তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গা শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়টা। শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, খেলাধুলা এসব আছে। স্কুলে নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, খেলাধুলা, বন্ধুত্ব, শারীরিক শিক্ষা গ্রহণ করবে এটা তারা কল্পনাই করতে পারে না। এই দেশের বেশির ভাগ মানুষই এগুলোকে শিক্ষার মধ্যে ফেলে না। অনেকে এসবকে খারাপ শিক্ষা মনে করে। আসলে দীর্ঘদিন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মুখস্থ, গাইড-নোট, কোচিং নির্ভর হওয়ার কারণে প্রজন্ম অনেকটা সংকীর্ণমনা হয়ে গেছে। যতটা সংস্কৃতবান প্রজন্ম আমাদের পাওয়ার কথা ছিল তা আমরা পাইনি। নাচ, গান, অভিনয় তো পরের কথা, আমি অনেক পরিবারেই দেখেছি পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই পড়াকে ভালো চোখে দেখে না। মনে করে, গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়লে ছেলে-পেলে খারাপ হয়ে যাবে। 

আমাদের শিল্প, সাংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র বিলীন হয়েছে, পাঠাগার বিলীন হয়েছে, শহরাঞ্চলে খেলার মাঠ হতাশাজনকভাবে কমে গেছে, সাহিত্য চর্চা, লিটলম্যাগ আন্দোলন সবই স্তিমিত। গোটা দেশ যেন ইট-পাথর দিয়ে সাজতে ব্যস্ত। এই অবস্থায় মানুষের মনে সংকীর্নতা বাসা বাধবে সেটাই স্বাভাবিক। অধিকাংশ মানুষ দীর্ঘদিন একটা বৃত্তের মধ্যে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সহজে সেই বৃত্তের বাইরে যেতে চায় না। কিন্তু বৃত্ত থেকে বের হতেই হবে। জাতির পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। 

পরীক্ষা বা মান নির্ধারণ পদ্ধতি নিয়ে যেসব অভিযোগ আছে। এ ব্যাপারে আমি বলবো যে, মান নির্ধারণীটা যেন বিশ্ব মানের হয়। আমাদের শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট যেন বিশ্বের যে কোনো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্ম প্রতিষ্ঠান বুঝতে পারে।

একটা উন্নত, আধুনিক, বিশ্বমানের শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করা যত কঠিন বাস্তবায়ন করা তার চেয়ে অধিক কঠিন। প্রথমত পর্যান্ত  মানসম্মত শিক্ষক থাকতে হবে, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার বিষয়টা বিবেচনায় রাখতে হবে। দেশের অনেক শিক্ষকই দীর্ঘদিন ধরে প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিংমুখি। তারা ক্লাস রুমের চেয়ে প্রাইভেট ও কোচিংকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছিলেন। তাদেরকে এদিক থেকে মুখ ফেরাতে হলে কিছু ব্যবস্থা তো গ্রহণ করতেই হবে। আমি প্রথমেরই বলবো তাদের চাকরির গ্রেডে উচ্চ, ও আলাদা বেতন স্কেল তৈরি করার কথা। এতে তাদের সামাজিক মর্যাদাও বাড়বে। সামাজিক মর্যাদা বাড়লে মেধাবিরাও শিক্ষকতা পেশায় আসতে ইচ্ছুক হবে। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্লাস রুমকে আধুনিকায়ন করতে হবে। প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ম্যাগাজিন ও দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকতে হবে বিজ্ঞান ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, সমৃদ্ধ পাঠাগার, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য একটা হলরুম, ইনডোর খেলার ব্যবস্থা, আউটডোর খেলাধুলার জন্য উপযুক্ত মাঠ ইত্যাদি। প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করতে হবে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে। বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ পহেলা বৈশাখও পালন করতে হবে। প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছরে অন্তত একবার বইমেলার আয়োজন থাকত হবে। প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত গাইতে হবে যথাযথ ভাবগাম্ভির্য ও সম্মানের সঙ্গে। বিজ্ঞানমেলা, বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে হবে। শিক্ষার্থীর রাখতে হবে একটা আনন্দমুখর হাসিখুশি পরিবেশে। কোনো মানসিক চাপ থাকবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে আনন্দের জায়গা, সহপাঠী, শিক্ষক সবার সঙ্গে প্রাণে প্রাণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠার জায়গা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত করতে ম্যানেজিং কমিটির অহেতুক খবরদারি থেকে। ম্যানেজিং কমিটি শিক্ষকদের পরামর্শ দিতে পারবেন, কিন্তু তাদের ওপর ছড়ি ঘুরাতে পারবেন না। বিশেষ করে আমাদের গ্রামাঞ্চলে অশিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত গ্রাম্য মোড়লগণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিতে ঢুকে গিয়ে তাদের মতামত জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন। অনেক সময় রাজনৈতিক শক্তি দেখিয়ে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমি দখল করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এসব থেকে মুক্ত করতে হবে।

সবশেষে বলবো, কোনো কারিকুলামই শতভাগ শুদ্ধ নয়, চর্চার মাধ্যমে শুদ্ধ করতে হবে। চর্চার জন্য উপযুক্ত উপকরণ ও পরিবেশের ব্যবস্থা করতে না পারলে এই কারিকুলামও ব্যর্থ হবে। যেমন ব্যর্থ হয়েছে সৃজনশীল পদ্ধতি। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক      



আরো পড়ুন