২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

কয়া গ্রাম: আলোর গল্প

রকিবুল হাসান || ২৫ এপ্রিল, ২০২৩, ০১:৩৪ পিএম
কয়া গ্রাম: আলোর গল্প


কয়া গ্রাম। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার একটি গ্রাম। বিখ্যাত গ্রাম হিসেবে গ্রামটির সেভাবে পরিচিতি না থাকলেও গ্রামটি বিখ্যাত। রবীন্দ্রনাথ এই গ্রামে এসেছিলেন, অনেকবারই এসেছিলেন। এই গ্রামের বিখ্যাত আইনজীবী বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত আইনজীবী ছিলেন। এই পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল গভীর। তিনি এই চ্যাটার্জি পরিবারে আসতেন। এই গ্রামে তিনি কবিতাও লিখেছেন। 

চ্যাটার্জি পরিবারের আর এক বিখ্যাত সন্তান ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ‘পারিবারিক স্মৃতি’ গ্রন্থে এসবের বিস্তর বর্ণনা রয়েছে। বসন্তকুমার চট্টাপাধ্যায় ও ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বোন শরৎশশী দেবী কবি ছিলেন, সমাজসেবক ছিলেন। চ্যাটার্জি পরিবারের বিখ্যাত ভাগ্নে বিপ্লবী বাঘা যতীন এ গ্রামেই জন্মেছেন, এ গ্রামেই বড় হয়েছেন। তিনি বিপ্লবী হলেও মনে প্রাণে সাহিত্যমনস্ক ছিলেন। কবিতা লিখতেন, ‘সত্যাগ্রহ’ পত্রিকা করতেন। 

বাঘা যতীনের ভাতিজা অর্থাৎ ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পৌত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সৌমিত্রের পিতা মোহিতকুমার চট্টাপাধ্যায়ের জন্ম কয়া গ্রামে। বাঘা যতীনের বড় বোন বিনোদবালা সেই সময়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করেছেন। তিনি বিপ্লবী ছিলেন। কবি ও প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর সুপরিচিত ছিল। ভালো শিক্ষক ছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আইন বাতিল করার জন্য প্রথম প্রতিবাদ সভা হয়েছিল কয়া গ্রামে। সেই সভায় বক্তৃতা করেছিলেন ললিতকুমার ও বাঘা যতীনসহ এলাকার অনেকেই। 

এ গ্রামের আর এক বিখ্যাত সন্তান ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন। ছোটবেলায় নিজের বাড়িতে তিনি রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাতলাভ করেছিলেন। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হিসেবে গত শতকের ৫০-৬০ দশকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তাঁর অনুজ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আজিজুল ইসলাম। তিনি আমেরিকায় অধ্যাপনা করতেন। রাজনীতিক ব্রজেন বিশ্বাস ‘মোহিনী মিল ও শ্রমিক আন্দোলন’ গ্রন্থ রচনা করে দায়িত্ববোধের পরিচয় রেখেছেন। শেখ লোকমান হোসেন বেশ কয়েকটি গবেষণাধর্মী ইসলামি গ্রন্থ লিখেছেন। গোলাম রহমান গোলাপের ‘বাঘা যতীনের দেশে’ নাটকটি একসময় রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ কুঠিবাড়িসহ বিভিন্ন জায়াগায় মঞ্চস্থ হয়েছে, প্রশংসিতও হয়েছিল। যদিও নাটকটি পরে গ্রন্থ রূপে প্রকাশ হয়নি।  এ গ্রামের কৃতী সন্তান ডা. মেজবাহুর রহমান, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কমান্ডার রাশেদুজ্জামান ও অধ্যাপক ড. মোকাররম হোসেন প্রমুখ।

সিনেমাজগতেও কয়া গ্রামের আলো আছে। পরিচালক-প্রয়োজক আবু তালেব, প্রযোজক অনীল ঘোষ, পরিচালক শাহেদ চৌধুরী, চলচ্চিত্র-সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মন্টু, খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহক আলমগীর খসরু-এঁরা সবাই কয়ার সন্তান। 

বর্তমান সময়ে অনেকেই লিখছেন। অশোক বিশ্বাসের কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে দু বছর আগে। লিপি আক্তারের বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিক ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি সুপরিচিত। সাহিত্য সংগঠক হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এস. আকরাম হোসেনের সাহিত্যজীবন দীর্ঘদিনের। শিগগিরই প্রকাশিত হবে তাঁর গ্রন্থ। রফিজউদ্দিন লিখেছেন অনেকগুলো উপন্যাস, নাটক ও কাব্যগ্রন্থ। যদিও কোনো গ্রন্থ প্রকাশ হয়নি। কিন্তু তাঁর চর্চা নিরলসভাবে চলছে। আখের উদ্দিন বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। কবি হিসেবে এলাকায় সুপরিচিত ।

কয়া হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করে রমজান চেয়ারম্যান, অধ্যক্ষ আবুল হোসেন, আকমল হোসেন, শেখ আজিজুল হক (আজিজ টান্ডেল), আইয়ুব চেয়ারম্যানসহ আরও অনেকেই যে অসামান্য দায়িত্ব পালন করে গেছেন, তার ধারাবাহিকতায় এ গ্রামে কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তাতে করে এ গ্রামে বর্তমানে খুব কম পরিবারই পাওয়া যাবে যে পরিবারে বিএ এমএ পাস ছেলেমেয়ে নেই। এখানকার সব মানুষ একেবারে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার। এখানে ধর্মচর্চা আছে, কিন্তু অন্ধত্ব বা গোঁড়ামি নেই। শিল্প সাহিত্য খেলাধূলা সব আছে। কোন বাধা নেই। সবাই মিলেমিশে একাত্ম। 

এ গ্রামের আর এক কৃতী সন্তান নাসিরউদ্দিন মাস্টার। সাদামনের একজন মানুষ। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন বিশাল পাঠাগার ও ফলের বাগান। সেই বাগানে রয়েছে বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক-বিপ্লবীবের নামে করর্নার। আমার সৌভাগ্য, আমার নামেও তিনি সেখানে কর্নার করেছেন। ছাত্রের প্রতি একজন শিক্ষকের এ এক গভীর ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। তিনি গ্রামে গ্রামে বই নিয়ে পাঠকের কাছে ছুটে যান। নিজের উদ্যোগে বইয়ের মেলা করেন। শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছেন প্রায় একক সাধনায়। 

আমার পিতামহ আব্দুল গনি শেখ। প্রচণ্ড সাহসী মানুষ ছিলেন। ধারণ করতেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা।গভীরভাবে লালন করতেন দেশপ্রেম। ব্রিটিশরা যখন কয়া গ্রামে অত্যাচার করতো, কলকাতার ব্রিটিশবাহিনীর প্রধান ট্রেগার্ট পর্যন্ত কয়া গ্রামে কয়েকবার হানা দিয়েছিল, বাঘা যতীনকে গ্রেপ্তারের জন্য। কয়া গ্রামের নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার কাছে প্রত্যেকবার ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়েছিল ট্রেগার্ট বাহিনীকে। আমার পিতামহ আব্দুল গনি শেখ তাঁর বন্ধুদের নিয়ে একবার ব্রিটিশ সৈন্যদের পিটিয়ে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। বাঘা যতীনকে তাঁরা ধারণ করতেন। তিনি হিন্দুপাড়ায় একেবারে বাঘা যতীনের বাড়ি ঘেঁষে নিজে বাড়ি তৈরি করে থাকতেন, যাতে বাইরে থেকে কোনো অপশক্তি এসে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করতে না পারে। আমি ও আমার ছোট ভাই মিলন হাসান আব্দুল গনি শেখের নাতি ছেলে। আমি এখানে আমার কথা বলতে চাইনি, চেয়েছি মিলন হাসানের সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করতে। মিলন আমার সবচেয়ে ছোট ভাই। লেখালেখি করে। 

ব্যবসা-বাণিজ্য করে। রসায়ন শাস্ত্রে বিএসসি অনার্স, এমএসসি। তাঁর ‘চন্দ্রঢেউ’ চমৎকার গল্পের বই। বিভিন্ন পত্রিকায় একসময় নিয়মিত কলাম লিখতো। কবিতাও। এখন প্রচুর গান লেখে। দেশবরেণ্য শিল্পী শফি মন্ডল, মিলন মাহমুদ ও লায়লার মতো শিল্পীরা তাঁর গান করেছেন। মিলন গ্রামকে ভালোবাসে, গ্রামের মানুষকে ভালোবাসে। গ্রামের দরিদ্র মানুষের বা কোন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় তাঁর দুহাত সবসময়ই সাধ্যমতো প্রশস্ত থাকে। শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতি-খেলাধূলায় গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে থাকে, বলা যায় একাত্ম হয়ে থাকে। সে ইচ্ছে করলে এসব থেকে দূরে থাকতে পারে অনায়াসে, কিন্তু থাকে না, এটা নিজের দায় ও দায়িত্ব মনে করে। দায়িত্ব পালন করতে সে ভালোবাসে। এবং তা আনন্দের সঙ্গেই করে, হাসিমুখেই করে। 

নিজের ভাইকে নিয়ে একথাগুলো না বললেও পারতাম, কিন্তু একজন ব্যক্তি মিলন হাসানের মহৎ প্রয়াস, যা হতে পারে এলাকার জন্য বড় রকমের একটা আলো, সেই আলোর কথাটা তো বলা আমারও নৈতিক দায়িত্ব। এলাকায় নিঃস্বার্থভাবে একজন মানুষ যখন এলাকার মানুষকে ভালোবেসে, নিজের সবটুকু সামর্থ্য ঢেলে দিয়ে পাশে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে, সেই মহৎ প্রয়াসকে বাস্তবে রূপ দিতে আমাদের সবারই উচিত তাঁর পাশে থাকা। যেভাবে এবার দেখেছি সবাইকে তাঁর পাশে। এতে আশান্বিত হয়েছি অনেক বেশি। স্বপ্ন দেখতেই পারি, কয়া গ্রামের আলোর ধারায় যোগ হবে আর এক নতুন আলো, যার ঘটে গেছে আরো আগেই। এখন শুধু এগিয়ে যাবার সময়, ভালোবেসে একাত্মতায়।



আরো পড়ুন