টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গোড়াই শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাসের চাপ না থাকায় চালু রাখা যাচ্ছে না বিদ্যুৎ উৎপাদনের জেনারেটর। এতে বিপাকে পড়েছে এ অঞ্চলের কল-কারখানাগুলো। এদিকে, কারখানা ভেদে উৎপাদন কমেছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। বড় শিল্পকারখানাগুলো বিকল্প পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ধরে রাখলেও খরচ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কারখানার মালিকরা বলছেন, গ্যাস সমস্যার সমাধান করা না গেলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
জানা গেছে, গোড়াই শিল্পাঞ্চলে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ বিদ্যুৎ না থাকায় কারখানার বিভিন্ন ইউনিট বন্ধ রাখতে হয়। এতে অনেক শ্রমিক বসে বসে অলস সময় পার করেন। আগে যখন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হতো, তখন প্রতিদিনই ওভারটাইম করে বাড়তি ইনকাম করতেন এখানকার শ্রমিকেরা। বিদ্যুৎ পেতে সমস্যা হওয়ায় এখন আর বাড়তি ইনকাম করতে পারেন না। এতে তাদের সংসার চালাতে বেগ পেতে হচ্ছে।
অনেক শ্রমিক কারখানায় কাজ বাদ দিয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন, কেউ কেউ রাজ মিস্ত্রিসহ দৈনিক শ্রমভিত্তিক কাজে চলে যাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হলেও দক্ষ শ্রমিক পেতে বেগ পেতে হতে পারে বলে মনে করছেন কারখানা সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে শিল্পাঞ্চলের উত্তরা স্পিনিং মিলে গিয়ে দেখা যায়, জেনারেটর চালু রাখতে যেখানে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ প্রয়োজন, সেখানে রয়েছে এক পিএসআই এর নিচে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জেনারেটর। যদিও তারা ২২ পিএসআই গ্যাসের সংযোগ নিয়েছেন। বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ায় বন্ধ রয়েছে কারখানার বেশ কয়েকটি ইউনিট।
প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলী (রক্ষণাবেক্ষণ) হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আগে এখানে গ্যাসের চাপ থাকতো ১৫ থেকে ১৯ পিএসআই। আর এখন চাপ থাকে এক পিএসআই এর কাছাকাছি। ফলে জেনারেটরের ৩০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। আর কারখানারও ৩০ ভাগ চালু রাখা যায়। এতে কারখানাটি ব্যবসায়ীক ক্ষতির মাঝে রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে এটি বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।’
কারখানার সহকারী ডায়িং মাস্টার মো. ইউসুফ, কোয়ালিটি অফিসার উম্মে সালমা ও শ্রমিক সায়ের বানি বেগম জানান, নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় এখন আর আগের মতো কাজ হয় না। আগে প্রতিদিনই ওভারটাইম করতে পারতেন। বাড়তি আয় হতো সংসারও ভালোভাবে চালাতে পারতেন। এখন বিদ্যুৎ কম থাকায় ওভারটাইম বন্ধ রয়েছে। আয় কমে গেছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তাদের আয় কমেছে। এতে সংসার পরিচালনা করা বেশ কষ্ট হয়ে পড়েছে। এর প্রভাবে তাদের অনেক সহকর্মী চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন। যারা আছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই চলে যেতে চাইছেন।
মিলের প্রজেক্ট ডিরেক্টর বিধান সরকার বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে কারখানা শ্রমিকেরা তাদের চাকরি পরিবর্তন করেন। এ কারণে শিল্প-কারখানায় প্রতিনিয়ত শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু বিদ্যুতের সমস্যার কারণে গত ৬ মাসের মধ্যে কারখানায় নতুন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যদিও এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৪০ ভাগ শ্রমিক চলে গেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কারখানার বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়াটি গ্যাস জেনারেটরের উপর নির্ভর করে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর জন্য ২২ পিএসআই গ্যাসের চাপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কখনো কখনো তা এক পিএসআইএর নিচে নেমে আসে, তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যহত হয়। আমাদের যেসব জেনারেটর ছিল, সেগুলো ১ দশমিক ৫ পিএসআই এর নিচে আসলে জেনারেটর বন্ধ হয়ে যায়। তাই উৎপাদন ধরে রাখতে কম গ্যাস চাপে চলে এমন নতুন জেনারেটর এনেছি। কিন্তু গ্যাসের চাপ এত কম যে সেগুলোও কাজে আসছে না। এতে ৩টি ইউনিটের মধ্যে একটি ইউনিট চালু রয়েছে। বাকি দুটি বন্ধ।’
অনেকটা একই অবস্থা নাহিদ গ্রুপ অব কোম্পানিজের। তিন শিফটে ছয় হাজারের অধিক শ্রমিক কাজ করলেও গ্যাস সংকটে উৎপাদন কমেছে প্রায় ৬০-৭০ ভাগ এমনটাই বলছে কর্তৃপক্ষ। উৎপাদন সক্ষমতা ১৩০ থেকে ১৩৫ টন থাকলেও গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ টন। বেশ কষ্ট করে শ্রমিকদের বেতন ভাতা দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করা হয় কোম্পানির পক্ষ থেকে।
আর ইমপ্রেস-নিওটেক্স কম্পজিট টেক্সটাইল লি. এর জেনারেল ম্যানেজার (ইউটিলিটি অ্যান্ড মেইনটেনেন্স) প্রকৌশলী শিকদার ওয়াহেদুজ্জামান জানান, গোড়াই এলাকায় তাদের কোম্পানির দুটি ইউনিট রয়েছে অ্যাপারেল ইউনিট ও টেক্সটাইল ইউনিট। গত ছয় মাস ধরে অ্যা ইউনিটে গ্যাসের চাপ শূন্য থাকছে। সেখানে গ্যাস জেনারেটর কোনো কাজেই আসে না। ডিজেল জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। তাদের চাহিদার অর্ধেক গ্যাসও পাওয়া যায় না বর্তমানে। উৎপাদন ধরে রাখতে গ্যাসের পরিবর্তে ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালু রাখতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। আর টেক্সটাইল অংশে তিনটি গ্যাস জেনারেটর রয়েছে, যার উৎপাদন ক্ষমতা ৪ দশমিক ৬ মেগাওয়াট। গ্যাস সংকটের কারণে সেখান থেকে মাত্র ৮০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে। পল্লী বিদ্যুৎ ও ডিজেল জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে চেষ্টা করছি। এতে উৎপাদন খরচ তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যাচ্ছে। তিনিও গ্যাস সংকট দূর করার দাবি জানান।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফোরাম (কালিয়াকৈর, মির্জাপুর, কোনাবড়ি) এর আহ্বায়ক বিধান সরকার বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের অধীন দুই শতাধিক শিল্প কারখানা রয়েছে। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ৫ লাখ লোকের। গ্যাস সংকটের কারণে এ সব শিল্পকারখানয় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান।’
এ ব্যাপারে তিতাস টাঙ্গাইল জোনাল বিপণনের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী খোরশেদ আলম বলেন, ‘টাঙ্গাইলের আবাসিক ও শিল্পকারখানার বাণিজ্যিক মিলিয়ে প্রতিদিন ৮০ মিলিন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। সঞ্চালন বিভাগ থেকে ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট বা তার চাইতেও কম গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে আমরাও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গ্যাস বিতরণ করতে পারছি না।’ এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন তিনি। দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে বলে কর্তৃপক্ষ তাকে জানিয়েছেন।
ঢাকা বিজনেস/এইচ