রুবেল সাইদুল আলম। শিল্পমনা, প্রকৃতিপ্রেমী, বন্ধুবৎসল, স্বপ্নবাজ ও খেয়ালি একজন মানুষ। বন্ধুদের মাঝে আড্ডা মাত করাতে তাঁর জুড়ি নেই। কিন্তু কারো কারো কাছে আবার তাকে খুব রাশভারী, অধরা বোধ হয়। তিনি একাধারে একজন কবি, কণ্ঠশিল্পী, বাউল গবেষক এবং একজন সরকারি আমলা। তিনি বাংলাদেশ কাস্টমসের একজন ডেপুটি কমিশনার হিসেবে দেশের জন্য কাজ করছেন। যদিও তিনি নিজেকে কখনো আমলা বলে মেনে নেন না। তিনি নিজেকে বলেন কামলা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছে এখনো সমান জনপ্রিয় এই মানুষটি আসলে একটু ভাবুক প্রকৃতির, উদাস একজন মানুষ। জীবনবোধের বিভিন্ন পরিসর তিনি অনুভব ও উপলব্ধি করেন নিবিড়ভাবে। ব্যক্তিগত জীবনে মানুষটি যেমন খুব প্রাঞ্জল, আড্ডাপ্রিয়, অগোছালো একজন, তেমনি কর্মীজীবনে তিনি খুব কঠোর ও দায়িত্ববান। আজ তাঁর সমন্ধেই আমাদের আলোচনা।
বেড়ে ওঠা মধুর শৈশব
রুবেল সাইদুল আলমের জন্ম চাঁদপুর জেলার মতবল উত্তর উপজেলায়। যদিও ওই সময় মতলব উপজেলা ছিল অবিভক্ত মতলব। যতদূর জানা যায়, তাঁর জন্ম হয়েছে তাঁর নানা বাড়িতে চৈত্র মাসের তিরিশ তারিখের বিকেল বেলায়। কিন্তু কালের বিবর্তন আর ঋতুর আবর্তনে এবং ইংরেজি মাসের দিনক্ষণ মিলিয়ে এখন তাঁর জন্মদিন পালিত হয় ১৪ এপ্রিল, ১ বৈশাখ। তাঁর একটা বর্ণিল শৈশব ছিল। দুর্দান্ত ও দুরন্ত এক বর্ণিল শৈশব তিনি কাটিয়েছেন গ্রামে। শৈশবে নানা বাড়ির সাথে ছিল তার গভীর যোগাযোগ এবং দারুণ সব স্মৃতি। কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীতের সকাল, রাত জেগে ধান মাড়াই দেখা, পাশাপাশি কৃষকদের মুখে গান শোনা, সন্ধ্যা রাত থেকে ভোর রাত পর্যন্ত পিঠা বানানোর উৎসব, সকাল বেলা গরুর গোয়াল ঘরে পানি, খৈল- ভুসি খাইয়ে মুনিদের গরু নিয়ে মাঠে বের হয়ে যাওয়া, দুপুরে কাজের ফাঁকে গাছতলায় কৃষকের একটু জিড়িয়ে নেওয়া, সেই বিশ্রামের ফাঁকে গান ধরা, বাঁশি বাজানো, এগুলো তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর শৈশবে।
তিনি মনে করেন, এগুলো তাঁকে ঋদ্ধ করেছে। জীবন বোধের আপেক্ষিকতায় তিনি অনেকের চেয়ে বেশি স্মৃতিকাতর ও গ্রামীণ ঐতিহ্যের ব্যাপারে অনেক মানস সমৃদ্ধ। গ্রীষ্মকালে ঝড়ের দিনে তিনি শত বাধা উপেক্ষা করে তার ছোট খালার সঙ্গে আম কুড়িয়েছেন, কত বড় বড় শিলা তাঁর গায়ের উপর পড়েছে তার ইয়াত্তা নেই। কিন্তু আম কুড়ানোর সুখ তিনি পেয়েছেন শৈশবে। তেমনি বর্ষার শেষ দিকে পানি যখন নেমে যাওয়া শুরু করতো, তখন খাল-বিলে ছিল পুটি, টেংরা, বৈচা, পাবদা, ছোট দেশি চাঁদা মাছ, চিংড়ি , কৈ, শিং, শোল, বোয়াল, টাকি মাছসহ অনেক ধরনের মাছে পরিপূর্ণ। পানির টানের সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর মাছ নামতো। তখন খালে জাকি জাল, পেলুন, চাইর পেতে মাছ ধরেছেন, দেখেছেন। তাঁর দাদার সঙ্গে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সঙ্গ দিয়েছেন। বর্ষায় পানির সাথে পাল্লা দিয়ে যখন ধানের গাছ উপরে উঠতো, তখন দেখেছেন সেই দিগন্ত জোড়া সবুজ-শ্যামল ফসলের মাঠ। দেখেছেন ডুবিয়ে ডুবিয়ে কৃষকদের পাট কাটার দৃশ্য। দেখেছেন পাকা ফসলের মাঠ, পথের ধারে ফুটে থাকা হরেক রকমের বুনো ফুল, পাকা ধানের সোনালি মাঠ, রঙিন প্রজাপতি, ঘুঘু, ফিঙে, চড়ুই, টিয়াপাখি, শ্যামা, বুলবুলির খেলা, শুনেছেন তাদের গান। তাঁর নানা বাড়িতে ছিল প্রচুর গাছপালা। সকালের ঘুম ভাঙতো হাজারো পাখির কলতানে। সন্ধ্যা বেলায় ঠিক একইরকম মুখরিত থাকতো বাড়ির পাশের বাগান।
বৈশাখী মেলার যেতেন নিয়মিত, যার আঞ্চলিক নাম ছিল ‘গলিয়া’। দুই দিনের মেলা, চৈত্র সংক্রান্তির দিন ও পহেলা বৈশাখের দিন। মুড়ি-মুড়কি খাওয়া, গজা খাওয়া, লাট গাছে (চড়কি) চড়া, নানান রকমের খেলনা কেনা, বেলুন ফুলানো, ঘুড়ি কেনা এসব ছিল ওই মেলার নিত্য-নৈমিত্তিক কর্ম। তারপর বাড়ির দক্ষিণ দিকের বিশাল বাগানে বসন্তের বাতাস খেতে খেতে সেই খেলনার ঝাঁপি নিয়ে বসা, কার থেকে কার খেলনা বেশি, কত রঙিন সে নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে তুমুল প্রতিযোগিতা, হট্টগোল। বিকালে হতো ঘুড়ি কাটাকাটি খেলা। আহ! শৈশব।
তিনি আলাপচারিতায় জানান যে, মতলবে এক বিখ্যাত ওলির মাজার আছে। যাঁর নাম সোলেমান ল্যাংটা। তাঁর নামে ওই মাজার কেন্দ্রিক চৈত্র মাসে সাত দিনের মেলা বসতো। এখনো প্রচলিত আছে। সেই মেলায় তিনি ও তাঁর সহপাঠী, চাচাত ভাইয়েরা একসঙ্গে দলবেঁধে তাঁর দাদার সঙ্গে যেতেন নিয়মিত। সে এক এলাহি কাণ্ড। কয়েক লাখ লোকের সমাগম হতো ওই মেলায়। সবচেয়ে বড় ভয় থাকতো হারিয়ে যাওয়ার ভয়। সেজন্য তাঁর দাদা মেলায় ঢুকেই তাদেরকে একটি বড় কড়ই গাছ দেখিয়ে বলে দিতেন যে, যদি কেউ হারিয়ে যায় তবে যেন এই গাছে নীচে এসে দাঁড়ায়, অপেক্ষা করে। কি যে এক অদ্ভুত অনুভূতির ব্যাপার ছিল সেই মেলা! তা ভাষায় বুঝানো যাবে না। এত এত মানুষ, এত এত পাগল, হাজারো দোকান-পাট, লাখে লাখে খেলনা, খাবার ও মনোহরি জিনিসপত্র। সেখানে বাংলাদেশের সব প্রখ্যাত বাউলরা সাত দিনব্যাপী গান করতেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভক্তবৃন্দ আসেন এই মেলায়। ভারত থেকেও আসেন। শীতের রাতে বাড়িতে না বলে অনেক সময় তিনি মশারির ভেতর ল্যাপের নীচে কোল বালিশ রেখে পিছনের দরজা দিয়ে চলে গিয়েছেন বাউলগান শুনতে। ফিরেছেন আবার সবার ঘুম ভাঙার আগে আগে ভোর রাতে, যাতে কেউ টের না পায়। তিনি শৈশবে অনেক প্রখ্যাত ও দিকপাল বাউলদের গান শুনেছেন মঞ্চের সামনে বসে। এদের মধ্যে পাগল বাচ্চু, মনির সরকার, রশিদ সরকার, খালেক দেওয়ান, মালেক দেওয়ান, মাখন দেওয়ান, খালেক সরকার, মালেক সরকার, আকলিমা বেগম, বাউল মাতা আলেয়া বেগম, মায়ারানী প্রমুখ অন্যতম। তাঁর মতে, সেখান থেকেই একটা বাউলা মন তিনি লালন করে চলেছেন।
শিক্ষা জীবন
তিনি ছেলেবেলায় এক কঠিন অনুশাসনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। তিনি স্কুলে প্রতি ক্লাসে বরাবরই প্রথম হতেন। প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি তাঁর ক্লাসে প্রথম ছিলেন অর্থাৎ তাঁর রোল নম্বর ছিল এক। তিনি পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীতে কৃতিত্বের সঙ্গে বৃত্তি লাভ করেন। তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম ধনারচক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নাম নিশ্চিন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয়। তিনি ১৯৯৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্ক নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে পাস করেন। তারপর চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম শ্রেণীতে এইচএসসি পাস করেন। তারপর তিনি ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেখানে তাঁর বড় ভাই তখন পড়তেন। ভর্তির পূর্বেই তিনি সে বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণে যান বড় ভাইয়ের কাছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈসর্গিক দৃশ্য, সবুজ ছায়াবীথি, পাখির কলতান তাঁর ভেতরে এক মায়ার জন্ম দেয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, এই ছায়া আর মায়াবিথিতেই তিনি পড়বেন। তারপর তিনি সেখানে ভর্তি হন। এখানে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম শ্রেণীতে বিএসসিসহ (অনার্স) এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মাইক্রোবায়োলজি। মাক্রোবায়োলজির ওপর গবেষণার ফলসরূপ বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা জার্নালে তাঁর অনেক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। তিনি ২০১০ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান বিষয়ক এশিয়া প্যাসিফিক একাডেমিক কনফারেন্সে যোগদান করেন। বিশ্বের প্রায় পঞ্চাশটির মতো দেশ থেকে তরুণ বিজ্ঞানী/গবেষকরা সেই কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি তাঁর একটি গবেষণা কর্ম উপস্থাপন করেন এবং ‘বেস্ট ইয়ং ইনভেস্টিগেটর এওয়ার্ড’ অর্জন করেন।
কর্মজীবন
রুবেল সাইদুল আলম কর্মজীবনে একজন সরকারি কর্মচারী। তিনি ৩০তম বিসিএস এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে সহকারী কমিশনার পদে ২০১২ সালে যোগদান করেন। তাঁর চাকরিজীবন শুরু হয় কাস্টম হাউজ, মংলাতে। তারপর তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় জনস্বার্থে দেশের সেবা করে চলেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার পদে কর্মরত আছেন। তাঁর সৃজনশীলতা, কর্মনিষ্ঠা, কর্মদক্ষতা, দায়িত্বশীলতা, বাংলাদেশ কাস্টমসকে ব্যবসায়ীদের কাছে দুর্নীতিমুক্ত ব্যবসাবান্ধব করে তোলার জন্য তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার জন্য ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশন (WCO) ২০১৭ সালে তাঁকে ‘সার্টিফিকেট অব মেরিট’ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। এই অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি যেকোনো কমকর্তার জীবনে একটি স্বপ্ন এবং সমগ্র কর্মজীবনে একবারের জন্যই পেয়ে থাকেন। কিন্তু তিনি তা তাঁর চাকরি শুরুর পাঁচ বছরের মধ্যেই অর্জন করেছেন। অনেক কর্মকর্তা সারাজীবন চাকরি শেষ করেও তা পান না। অবসরে চলে যান। তিনি তাঁর চাকরির প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেধা এবং যোগ্যতার স্বাক্ষৰ রেখেছেন। সরকারের রাজস্ব আদায়ে তিনি একজন সফল ও স্বার্থক কর্মকর্তা। তাঁর বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে তাঁর সফলতার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি ভ্যাট গোয়েন্দা, তদন্ত ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের আওতাধীন উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।
সৃজনশীলতা
কঠিন এক কর্মজীবন নিয়েও এই মানুষটি একজন শিল্পমনা মানুষ। ভালোবাসেন বৃষ্টি, প্রকৃতি, বসন্তের বাতাস, কবিতা, গান-আড্ডা। তিনি কবিতা লেখেন, গান লেখেন, গান গাইতে পছন্দ করেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিনি গান করেন। ভালোবাসেন বাউলদের সান্নিধ্য, আখরাই আড্ডা ও সাধুসঙ্গ। বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল আড্ডা দেওয়া তাঁর দৈনন্দিন জীবনের খুব প্রিয় ও সুখকর একটা সময়। তিনি লেখালেখি করেন। বাউলদের নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁদের জীবন, দর্শন, জীবনবোধ, তত্ত্ব নিয়ে জানার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাঁর অনেক আর্টিক্যাল প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মনে করেন সৃষ্টি বা কর্মই একজন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে তাঁর অবর্তমানে। তাই অবিরাম নিজেকে ভাঙেন আবার গড়েন এই মানুষটি। তিনি মনে করেন, মানুষের আমার বলতে কিছুই নেই। এই পৃথিবী হলো একটি মায়া। যার পেছনে রয়েছে ভাব। এই ভাব সাগরের মিছে মায়ায় মানুষ ভুলে যায় যে, একদিন তাঁকে ফিরতে হবে অসীম ডাকের পানে, ফেলে রেখে এই কায়া।
ঢাকা বিজনেস/এম