শিমুল ভীষণ গাছপাগলা।
শহরতলীতে ওদের বাসাটা বাসা না বলে ছোটখাটো বন বলা যেতে পারে। পুরো বাড়িজুড়ে বনজ-ফলদ ওষুধি গাছভর্তি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এক বা একাধিক গাছ এনে বাড়ির চৌহদ্দিতে রোপণ করে শিমুল। নার্সারি থেকে তো কেনেই। বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত কারও বাড়িতে নতুন গাছ দেখলে সেটারও বীজ বা চারা বা কলম বা কাটিং কিছু না কিছু একটা আনা চাই-ই। এছাড়া চলতি পথে কিংবা বন, পাহাড়, জঙ্গলে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বেড়াতে গেলেও চোখে কোনো গাছ ভালো লাগলে তুলে নিয়ে আসে।
এজন্যই এই বাসাটাকে বাগান না বলে বন বলা যেতে পারে। সারা বছরই নানা রকম ফুলের গন্ধে বাড়িটা ম ম করে। আর এত গাছপালার কারণে টিয়ে, ময়না তো বটেই গহীন বনের পাখিও বাসা বেঁধেছে শিমুলদের বাগানে। গাছপালায় ঘেরা বিশাল বাড়িটা ছায়া সুনিবিড়। নানারকম ফুল-ফলের একটা সোঁদা ঘ্রাণ শিনশিন বাতাসের গায়ে অবিরাম মিশে থাকে। শুকনো পাতার ঝরে পড়ার শব্দ, বাতাসে পাতাদের নাচানাচির শব্দ, রকমারি পাখিদের কলতান, এ যেন এই ধূলি ধূসরিত, ইট, কাঠ, পাথরের জঙ্গলের ভিড়ে একটুকরো স্বর্গ। এই যেন আমাজন থেকে তুলে আনা খানিকটা অরণ্য।
শিমুলের দাদা গ্রামের পৈতৃক জমি প্রায় পুরোটাই বিক্রি করে শহরতলীতে এই এই সোয়া বিঘে জমি রেখেছিলেন। তখন দাম কম ছিল। পাঁচ হাজার টাকা কাঠা। এখন এই জমি মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। শিমুলের বাবা সাব্বির খান একটা মধ্যম মানের সরকারি চাকরি করতেন। দু্ই ভাই একবোন আর বাবা মা দাদিকে নিয়ে শিমুলদের সুখী পরিবার।
কিন্তু বিধাতা পৃথিবীতে কাউকেই নিরবচ্ছিন্ন সুখে রাখেন না। তাই হয়তো হঠাৎ করেই সাব্বির খান বিছানায় শয্যাশায়ী। প্রেসার যে ছিল, এমন কোনো লক্ষণ কোনোদিন প্রকাশিত হয়নি। সুস্থ মানুষ। অফিস গেলেন ফেরার পথে স্ট্রোক। শরীরের অর্ধেক প্যারালাইজড। চাকরি যায়নি। তবে অর্ধেক বেতন পান। সব অ্যালাউন্স বন্ধ।
শিমুলদের সুখের সংসারে দুঃখের প্রবেশ। আগের সেই সচ্ছলতা নেই। তবে মা সেটা বাবাকে লুকোতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। সুধী গোশত ছাড়া খায় না। মা তাই বাড়িতে এখন মুরগী পোষে। শোভন এবার এইচএসসি পাস করেছে। ওর ভর্তি কোচিংয়ের টাকাও মা ঠিক দিয়েছেন। তবে বলেছেন, টাকাটা যেন নষ্ট না হয় সেভাবে পড়িস বাবা। শিমুল জানে, মা গয়না বিক্রি করে শোভনকে টাকা দিয়েছেন। বাবার অফিস থেকে পাওয়া টাকায় তো খাওয়াই ঠিকমতো হয় না! মা ব্যাংকের সেভিংসেও হাত দিয়েছেন, বাবার চিকিৎসার খরচের জন্য।
বিকেলে আগে মাঝে-মধ্যে সবাই মিলে ছাদে বা বারান্দায় বসে গল্পগুজব হতো। মা চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গাইতে জানে। মা গান গাইতো। বাবা চা বানিয়ে আনতো, সঙ্গে মুড়িমাখা বা পেঁয়াজু! এখনো মাঝে মধ্যে বিকেলে বাবাকে হুইল চেয়ারে করে বারান্দায় নিয়ে আসা হয়। গল্প হয়। চা হয়। কিন্তু মা আর গান গায় না। একটা তাল কেটে যাওয়ার গোপন কান্না সবার বুকেই চিনচিন করে।
তবুও দিন কাটে।
শিমুলের ফাইনাল হয়ে গেছে। চাকরির চেষ্টা করছে। যদিও চাকরির প্রতি তেমন টান নেই। সব সময়ই ইচ্ছে ছিল কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে নেবে। নিজের ভালো লাগা দিয়ে কাজ করবে। কিন্তু বাবার অসুস্থতা সে স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। এখন তাই একটা ভালো চাকরি পাওয়াটাই শিমুলের প্রধান লক্ষ্য। তবে গাছপালার প্রতি ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে নয়।
শিমুল দুটো টিউশনি করে। চৌদ্দ হাজার টাকা পায়। কম না খুব একটা। মাকে দিয়েও হাতে ভালোই থাকে। বই কেনে। আর গাছ তো কেনেই।
যে জমিটুকুতে গাছ লাগায় শিমূল, ওটা এতকাল পড়েই ছিল বলতে গেলে। এবড়োখেবড়ো এবং ঢালু, বাড়ি করার উপযুক্ত নয়। কিছু নারকেল, সুপারির গাছ লাগানো হয়েছিল। কয়েকটা আম কাঁঠাল। পরবর্তী সময়ে কিছু আম-কাঁঠাল-পেয়ারার গাছ নিজে থেকে জন্মেছে। কিছু লতা- গুল্ম, দেওদারু আর বট জন্মেছে, বড়ও হয়েছে- নিজের মতো। খোলা খালি জমি, এলাকার ছেলেপিলেরা আড্ডা দিত, খেলতে আসতো। কেউ কেউ নিজেদের বাড়ির পাতাবাহার বা পাথরকুচি পাতা এনে ফেলে যেত। সে থেকেও নিজ মনে বড় হয়েছে কিছু।দাদার ইচ্ছে ছিল জমিটা দাম বাড়লে বিক্রি করে দেবেন। বাবারও ইচ্ছে ছিল সেটাই। তবে তার কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী পরামর্শ দিয়েছিল,জমিটা ভরাট করে, বাড়ি করার মতো মোটামুটি উপযুক্ত করে বিক্রি করলে এখনের চাইতে প্রায় তিনগুণ দাম বেশি পাওয়া যাবে। বাবাও সেজন্য হাতে টাকা আসার অপেক্ষায় ছিলেন।
মামা কেবল জমিটার কথাই বলে। জমিটা শহরতলী ছাড়িয়ে তাই দাম বেশি ওঠে না।এই যে এত এত রকমারি মূল্যবান ওষুধি গাছ, ফলদ গাছ—এসবের যেন কোনো মূল্যই নেই।
কিন্তু শিমূল নবম শ্রেণিতে ওঠার পর গাছ লাগানো ওর সখ আর নেশায় পরিণত হলো। এ যুগের ছেলেপিলে আড্ডা দেয়, ঘুরে বেড়ায়, ফেসবুক, ইন্সট্রগ্রাম, টুইটারে বিজি থাকে আর শিমূল তাদের সবার থেকে আলাদা। পড়াশোনা বাদে গাছ লাগানো, গাছের পরিচর্যাতেই ব্যস্ত থাকে।
বাবা সাব্বির খান, মা নাসরিন সুলতানা
দেখেন। দেখে দেখে খুশিই হন ছেলে আজবাজে পথে যাবে না ভেবে। দিনকাল ভালো নয়। সন্তান বাইরে গেলে বাসায় না ফেরা পর্যন্ত বাবা মায়ের স্বস্থি মেলে না। শিমুলকে নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা কমে যায়।
সেই তখন থেকে গাছ লাগাতে লাগাতে বাগানটা এত বড় হয়ে আর ঘন হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ দেশি ফল আর কিনতে হয় না। বসত বাড়ি বাদেও প্রায় বিঘে জমিতে বাগান এখন ছোটখাটো বন।
জমা টাকা ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। আসলে তেমন কিছু তো জমাও ছিল না। বাবা হাত খোলা মানুষ। হাতে টাকা থাকলে গরিব দুঃখীকে ফেরাননি কখনো। বাড়িতেও ভালো খাবার ভালো পোশাকের ব্যবস্থা করেছেন সর্বদা। তাই জমা ছিল সামান্যই। মায়ের গয়না ও গেছে। এদিকে মেরামতের অভাবে ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ছে। দাদার আমলের দেয়ালের পলেস্তরা খসতে শুরু করেছে। শিমুলকে না বললেও শিমুল বুঝে, ওর এখন সংসারের হাল ধরাটাই প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু—চেষ্টার ত্রুটি না থাকা সত্ত্বেও কোনোমতেই একটা চাকরি হচ্ছে না শিমুলের। আসলে যা তা চাকরি হলে তো হবে না। সংসারের অন্তত ষাট সত্তরভাগ প্রয়োজন মেটাতে পারতে হবে তো। ওর দিকে তাকিয়ে আছে পুরো পপরিবার, একটু স্বস্তির আশায়।
দাদি আর মা কয়দিন ধরে জমিটা বিক্রির ব্যবস্থা করার জন্য ছোট মামার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছেন। ছোটমামার এক বন্ধু ডেভেলপার কোম্পানিতে আছে। এজন্যই তার সঙ্গে কথা বলা। জমির বর্তমান বাজার মূল্য, এত এত গাছসহ মূল্য, ইত্যাদি।
মা মোবাইল ব্যবহার করে না। ল্যান্ড ফোনে কথা বলে। খাবার ঘরে ডাইনিং টেবিলের পাশেই ল্যান্ডফোন। ফলে খেতে বসে কিংবা ড্রইংরুমে টিভি দেখতে বসে মায়ের সব কথাই কানে আসে শিমুলের। ওপাশ থেকে বলা মামার কথাগুলো শুনতে না পেলেও মামা কী বলছে আন্দাজ করতে পারে। মামা কেবল জমিটার কথাই বলে। জমিটা শহরতলী ছাড়িয়ে তাই দাম বেশি ওঠে না।এই যে এত এত রকমারি মূল্যবান ওষুধি গাছ, ফলদ গাছ—এসবের যেন কোনো মূল্যই নেই।
যতবার মামা জমির দাম বলে, শিমুল ততবার মাকে গাছগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ওর মনে তীব্র বাসনা, জমিটা যেন বিক্রি না হয়।
মনে মনে ভাবে, একটা চাকরি হয়ে গেলে জমিটুকু বিক্রি করতে দেবে না।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা মানালি দের বাসা থেকে ফেরার সময় ফুটপাতে ইটের ফোঁকড় গলে গজিয়ে ওঠা আগাছার মাঝে ছোট্ট একটা গাছে চোখ আটকে গেল শিমুলের। ইঞ্চি সাতেক লম্বা গাছটার অন্যতম বিশেষত্ব হলো তার ত্রিভূজাকৃতির পাতা তিন রঙের। সবুজ, হলুদ আর নীল। গাছের পাতা সবুজ হয়, এটা তো স্বাভাবিক বিষয়, হলুদ বা লাল পাতাও দেখেছে শিমুল। কিছু পাতা ঝরে যাওয়ার আগে হলুদ বা লাল হয়। আবার কিছু সবুজ পাতার গায়ে লাল বা হলুদ কারুকাজ করা থাকে। কিন্তু নীল? পাতার গায়ে কোনোদিন নীল দেখেনি শিমুল ত্রিভূজ পাতার অর্ধেকটা জুড়ে গাঢ় ঘন নীল। সত্যিই অদ্ভূত! পৃথিবীতে কতই না বিস্ময়কর জিনিস আছে। তার বিন্দু পরিমাণও সম্ভবত সবচে জ্ঞানী মানুষটিরও জানা হয়ে ওঠেনি, আর শিমুল তো একটা খুবই সাধারণ ছেলে তার জানার বাইরে এমন নীল পাতার মতো লক্ষ লক্ষ বিস্ময়কর বিষয় থাকাটা তো খুবই স্বাভাবিক।
গাছটাকে দেখেই শিমূলের মনে হলো,একে নিতে হবে। সূর্য ডুবে গেছে। বেশ আবছা হয়ে এসেছে চারিপাশ। মানালিদের গলিটা হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেছে। গলির বুকে ক্রিকেট খেলতে থাকা ছেলের দল ঘরে ফিরে গেছে। কোনো গাড়ি রিকশা বা মোটরবাইক নেই। গলির গাঘেঁষা ফুটপাতে দূরের স্ট্রটি ল্যাম্পের মৃদু আলোয় সন্ধ্যাটা কেমন ছমছম করছে। আগাছার গুলোর কাছে গিয়ে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট ফেলতেই শিমুল দেখলো ইটের ওপর খুব হালকাভাবে শেকড় ছড়িয়ে বেড়ে উঠেছে গাছটা, তার পাশেই একটা সোনালু ফুলের গাছ। খুব আলতো টানে অচেনা গাছটাকে তুলে নিল শিমুল। তারপর লোকজনের চোখে পড়তে পারে ভেবে সোনালু গাছটাকেও টেনে তুলে নিলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে সামনে দাঁড়ানো রিকশাটাতেই উঠে বসলো।
ফুটপাত থেকে একটা গাছ তুলে নিয়েছে কিন্তু ভয় হচ্ছে গাছটা কারও চোখে পড়ে গেলে হয়তো অযথাই গ্যাঞ্জাম করবে। কেন, কোথা থেকে, কী নাম। শিমুল তো আসলে জানে না কিছুই। কেবল একদম ব্যতিক্রম বলেই না তুলে নিয়েছে গাছটা।
নিজের সংগ্রহে গাছ সংক্রান্ত সমস্ত বই ঘাঁটাঘাটি করেও গাছটার কোনো ছবি বা তথ্য পেলো না শিমুল। লাইব্রেরিতেও পড়াশোনা করলো কয়দিন। নাহ তিনরঙা ত্রিভূজাকৃতি পত্রযুক্ত কোনো গাছের বিবরণ পেলো না কোনো বইতে।
বাসায় নিজ ঘরের বারান্দাতেই একটা পুরান টবে গাছটা লাগিয়েছে শিমুল।একটু সতেজ হলে বাগানে নিয়ে লাগাবে। মা, সুধা, শোভন, দাদিমা—সবাইকে ডেকেছে গাছটা দেখাতে। শিমুল যখন প্রথম প্রথম গাছ লাগাতো, তখন এমনভাবে সবাইকে ডেকে গাছ দেখাতো, নতুন নতুন হরেক পদের গাছ, সবাই আনন্দ পেতো। কিন্তু আজকাল কেউ আসে না। এমনকি নতুন আনা গাছটার অদ্ভূত চেহারার বর্ণনা শুনেও গাছটা দেখায় আগ্রহী হয়নি কেউ।
লাগানোর পর প্রথম দু-তিন দিন গাছটা নেতিয়ে ছিল। তারপর নিজেই তরতাজা হয়ে উঠতে শুরু করলো। শিমুল লক্ষ করলো গাছটার বৃদ্ধি খুব ধীর।
চাকরির পড়া, টিউশনি, বাগান পরিচর্যা—সব মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত শিমুল। বাবার চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেওয়ার কথা ভাবছে মা । প্রচুর টাকা দরকার। জমিটা বিক্রি ছাড়া বিকল্প নেই। পুরো জমি বিক্রী করলে দুই আড়াই কোটি টাকা পাওয়া যাবে। জমি নয়, গাছগুলোর জন্য হাহাকার জাগছে শিমুলের। প্রায় বার তের বছর ধরে কত শখ করে কত কত গাছ লাগিয়েছে। জমিটা বিক্রি হলে ডেভেলপার কোম্পানি বুলডোজার দিয়ে সব গাছ মিশিয়ে দেবে মাটির সঙ্গে। ভাবলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কিন্তু জমি বিক্রি না করার জন্য বলতেও পারে না শিমুল। বাবা সুস্থ হয়ে উঠলে কত আনন্দই না ফিরে আসবে পরিবারে!
শিমূল একলাটি বসে ভাবে, ইশ কোনো একটা লটারি বা গুপ্তধন যদি মিলে যেতো! জমিটাও বিক্রি করতে হতো না, বাবাও সুচিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠতো।
মা এসে বলে, গ্রামের সবশেষ দুকানি ধানি জমি তিন লাখে বিক্রি হয়েছে।সংসার খরচে ওই টাকায় কিছুদিন চলবে। তবে বাগানের জমিটা বিক্রি না করলে বাবার চিকিৎসা হবে না। ডেভেলপাররা অনেক কম দাম বলছে, নাসরিন সুলতানা তার স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই সেটা বুঝতে পারছেন। তবে, আরও বেশি টাকার আশায় বসে থাকলে চিকিৎসার দেরি হয়ে যাবে, তখন বাবা আর সুস্থ নাও হতে পারেন।
মায়ের কথা শুনে কিছু সময় চুপ করে বসে থাকে শিমুল। গ্রামে আর কোনো সম্পত্তি অবশিষ্ট নেই। মায়ের গয়নাগাটি বিক্রি করা শেষ। এখন আছে কেবল এই বসতবাড়ি আর এই বাগানখানি। দাদি আছেন। মোটামুটি সুস্থ হলেও মাসে তার হাজার তিনেক টাকার ওষুধ লাগে। সুধী আর শোভনের পড়ার খরচ আছে। শিমুলের জন্য বাবা মা যা খরচ করেছেন ওদের জন্য সেটা করা হচ্ছে না। এজন্য শিমুলের নিজেরও খারাপ লাগে। মা তো নিজের কথা বোধহয় ভুলেই গেছেন। শিমুল পাস করে এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি।
বাবার চিকিৎসা খুব জরুরি। প্যারলাইজড তো হয়েই আছে। এরই মধ্যে মেরুদণ্ডেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেটার জন্যই বেশি অর্থ প্রয়োজন।
শিমুল মাকে বলে, মা আড়াই কোটিতে পুরো জমিটা না দিয়ে। আরেকটু দাম বলে অর্ধেকটা দাও। আপাতত চিকিৎসা শুরু হোক।
না না। আঁতকে ওঠে মা। চিকিৎসা অর্ধেক করে বসে থাকা যাবে না। আর পরে বাকিটুকু যদি কেউ কিনতে না চায়? বা এখন যারা নিচ্ছে তারা আরও কম দাম বলে এবং অন্যদের কিনতে না দেয়? পুরোটাই দিতে চাচ্ছি আমি।
বাবা কী বলে?
তোর বাবা আমাকে বলে, আমি যা ভালো মনে করি, তাই যেন করি। তোর বাবা বেঁচে থাকতে খুব ভালোবাসে। জীবন নিয়ে তার কত পরিকল্পনা। ছেলে-মেয়েদের একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলেই আমাকে নিয়ে দেশ ঘুরতে বেরোবে। কত স্বপ্ন তার। অসুস্থ হয়ে কেমন থমকে গেছে লোকটা।
মায়ের গলা ধরে আসে।
শিমুল কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বাবার স্বপ্ন গুলো যদি সত্যি হতো! কিন্তু জমি বিক্রি করে সুস্থ হলেও তো আর স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না। টাকাই তো থাকবে না। শিমুলের যদি একটা চাকরি হয়েও যায়, যত ভালো চাকরিই হোক শুরুতে কতই না বেতন হবে। সেটা দিয়ে সুধী আর শোভনের পড়ার খরচা দেওয়ার পর বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণে কি সহযোগিতা করা যাবে?
ধূর। কিচ্ছু ভালো লাগছে না শিমূলের।
জগতে সব কিছুতে শুধু টাকা আর টাকা দরকার ।
যখনই দরকার হবে গাছ থেকে টাকা পেড়ে নেবো। শিমুলের কাণ্ড দেখে সবাই হতভম্ব। মা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে ডাক দেন শিমুলকে, বাবা। এমন করছিস কেন?
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে বাগানে চলে আসে শিমুল। ঘন সবুজের মধ্যে এক অনাবিল শান্তির সুর জড়িয়ে আছে যেন। ছায়া ছায়া, সুনসান, বাতাসের ফিসফাস,মাঝে মধ্যে খুব মিষ্টি কণ্ঠের একটা অচেনা পাখির ডাক—লতাপাতা, গুল্ম, ঘাসের বুকে নাম না জানা হলুদ, সাদা-বেগুনী রংবেরংয়ের ছোট ছোট ফুল। কোথাও তেলকুচা ফল পেকে কাল হয়ে ঝুলে আছে। বুনোজামের থোকায় মৌমাছিদের ভিড়। অর্জুন, মেহগনি কড়ই গাছের সারি, তাদের ফাঁকে বরই, পেয়ারা, সজনে নীল মনি—কোনো গাছই পরিকল্পনা করে লাগানো নয় বলেই হয়তো ছোট্ট জমিটুকুকে জঙ্গলের মতো মনে হয়।
আনমনে হাঁটছিল শিমুল। একটা বন বিড়াল তীব্র বেগে ছুটে যাওয়ার সময় আচমকা ধাক্কা খেলো শিমুলের সঙ্গে। চমকে উঠলো শিমুল। কিন্তু ভয় পেয়ে আরও দ্রুত পালালো বন বেড়াল। একটু দূরে দুপায়ে দাঁড়িয়ে শিমুলকে দেখছিল একটা কাঠবেড়ালী। শিমুলের চোখে চোখ পড়তেই সেও টুপ করে লুকিয়ে পড়লো ঝোপের আড়ালে। ঝোপটার পাশেই তিনরঙা ত্রিভূজাকার পাতার গাছটি। দূর থেকে গাছটিকে কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে। গাছটা গত কয়মাসে কেমন লম্বা হয়ে উঠেছে। ডালের তুলনায় পাতা কম। আর অসংখ্য কুশি। ত্রিভূজ পাতাগুলো পরিপূর্ণ বয়সে দুই ইঞ্চির মতো লম্বা আর দেড় ইঞ্চির মতো চওড়া। উজ্জ্বল রঙে সারাক্ষণই হাসছে।
গত কয়দিন নানান ব্যস্ততায়। বাগানে আসা হয়নি। বাবা আর শিমুল-শোভনের পাসপোর্ট আছে। কিন্তু মায়ের নেই। সিঙ্গাপুরে মা একা বাবাকে নিয়ে ঠিক পেরে উঠবেনা। তাই সঙ্গে শোভনও যাবে। মা অবশ্য শিমুলকেই সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবাই না করলেন। শোভন আর সুধী দুজনেই ছোট। একা একা তারা কিভাবে থাকবে। শিমুলও এটাই চাইছিল। সামনে বেশ কয়েকটা ভাইবা আছে। বাবার সঙ্গে গেলে ভাইবাগুলো মিস হয়ে যাবে। চাকরির বয়স সীমিত। কোনোটা মিস হয়ে গেলে সারাজীবন তার খেসারত দিতে হবে।
মায়ের পাসপোর্ট করা। বাবারটা রিনিউ করার কাজ তাছাড়াও নিজের পড়াশোনা, টিউশনি সব মিলিয়ে ব্যস্ততায় বেশ কদিন পর বাগানে এসে ভালোই লাগছে শিমুলের। বাগানটা নিজে নিজেই রূপ বদলায়। কয়দিন বাদ দিয়ে এলে সেটা ভালোই চোখে পড়ে। হাঁটাচলার রাস্তাটায় ঘাস গজিয়ে ওঠে। ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে অবাধ্য ভঙ্গিতে। তিনরঙা ত্রিভূজ পল্লব শোভিত গাছটার কাছে এসে শিমুলের তো চক্ষু চড়কগাছ।
এ কি স্বপ্ন! নাকি সত্যি! না কী অবচেতন মনের কল্পনা?
পুরোটা গাছে, ডালের কুশি গুলো ফেটে ঝুলে আছে পাঁচশ, হাজার আর দুশো টাকার নোট। কোনো কোনো কুশি ফেটে দুই টাকার নোট খানিকটা শরীর বের করে রোদ খাচ্ছে। গাছের নিচে ঝরা পাতার মতো ধূলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে পাঁচশ, হাজার আর দশ বিশ টাকার নোট।
শিমুল কয়েক সেকেন্ড বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে থাকে। আর তারপর আনন্দে লাফাতে শুরু করে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মা সুধী, শোভন আর দাদিকে ডাকতে ডাকতে নিজেই গাছের নিচ থেকে টাকা কুড়িয়ে জড়ো করে। তারপর গাছে ঝুলতে থাকা পরিপূর্ণ টাকাগুলো পেড়ে নিতে থাকে।
গাছ থেকে টাকা পাড়ছে আর হাসছে শিমুল। আহ্ কত টাকা। বাবার চিকিৎসা হবে। দাদি আর মায়েরও হবে। বাসার ছাদ মেরামত হবে। বৃষ্টি হলে জল পড়বে না ঘরে। বাগানটা আর বিক্রি করতে হবে না। সুধী শোভন পড়াশোনার জন্য সব সুবিধা পাবে। শিমুল আর চাকরি খুঁজবে না। খামার করবে। আহা। সব দুঃখ শেষ।
কত্তগুলো হাজার টাকা। শিমুল পা উঁচিয়ে, হাত বাড়িয়ে টাকা পাড়ছে। শিমুলের গগণবিদারী চিৎকারে কোনো বিপদভেবে ঘরের সবাই দৌড়ে ছুটে এসেছে। শিমুলের কাছাকাছি এসে থমকে গেলো সবাই। শিমুল লাফিয়ে লাফিয়ে একটা গাছ থেকে কাঁচা পাতা টেনে টেনে ছিঁড়ছে আর বলছে, আর আমাদের অভাব থাকবে না। যখনই দরকার হবে গাছ থেকে টাকা পেড়ে নেবো। শিমুলের কাণ্ড দেখে সবাই হতভম্ব। মা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে ডাক দেন শিমুলকে, বাবা। এমন করছিস কেন?
কী হয়েছে তোর বল। শিমুল মায়ের কথার উত্তর দেয় না। লাফিয়ে লাফিয়ে দুহাত দিয়ে গাছের পাতা পাড়তেই থাকে।