২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শুক্রবার



মোংলায় যেভাবে বেড়েছে আমদানি-রপ্তানি

জামাল হোসেন বাপ্পা, বাগেরহাট || ০৯ জুলাই, ২০২৪, ০৬:৩৭ এএম
মোংলায় যেভাবে বেড়েছে আমদানি-রপ্তানি


দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা, সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যবসাবাণিজ্য। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল তথা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই বন্দর ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। গাড়ি আমদানি, বিদেশি জাহাজ আগমন, রাজস্ব আয়, কার্গো হ্যান্ডলিং ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে সব লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমে প্রধান সহযোদ্ধা হয়ে কাজ করেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।  

মোংলাবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শাহীন রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্ব ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে মোংলাবন্দরের গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এই বন্দর দিয়ে ৮৪৬ বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ আগমন করে। রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানি হয় ১৫ হাজার ৩৪০ ইউনিট। এ সময়ে কার্গো হ্যান্ডলিংও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং বেড়েছে। সব সূচক পজিটিভ ধারায় থাকার ফলে বন্দরে নিট মুনাফা ২৮.৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।’

শাহীন রহমান আরও জানান, পদ্মা সেতুর কারণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা বন্দরের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মহাকর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। এ বন্দর থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা ও তার পার্শ্ববতী জেলা থেকে পণ্য আনা-নেওয়া করার ক্ষেত্রে বন্দর ব্যবহারকারীদের সময় ও অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। পদ্মা সেতুর কল্যাণে রাজধানীর সব থেকে কাছের বন্দর হওয়ায় মোংলা হয়ে পোশাকশিল্পের বিভিন্ন পণ্যও যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। মোংলাবন্দরের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপন করায় পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে নবদিগন্তের সূচনা হতে যাচ্ছে। মোংলায় জাহাজ হ্যান্ডলিং দ্রুত ও নিরাপদ হওয়ায় বিদেশি ব্যবসায়ীরাও এই বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ফলে এই বন্দর দিয়ে এখন পণ্য আমদানি-রপ্তানি বেড়েই চলেছে।  

জাহাজ আগমনে (২০২২-২৩) থেকে (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরে মোংলাবন্দরের অর্জন
২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮২৭ জাহাজ এসেছিল। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাহাজ এসেছে ৮৪৬ টি। অর্থাৎ একবছরে ১৯টি জাহাজ বেশি এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জাহাজ আগমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৪০। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৬ টি জাহাজ বেশি এসেছে।

গাড়ি আমদানি(২০২২-২৩) থেকে (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরে মোংলাবন্দরের অর্জন
২০২২-২০২৩ অর্থবছরের মোট গাড়ি আমদানি হয়েছিল ১৩ হাজার ৫৭৬। অন্যদিকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১৫ হজাার ৩৪০ গাড়ি। পরের বছরে ১ হাজার ৭৬৪ গাড়ি বেশি আমদানি হয়েছে। গত ১০ বছরে এই বন্দর দিয়ে আমদানি গাড়ির সংখ্যা ১ কোটি ৭ লাখ ৮৫ হাজার ৯৭৯।

কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে (২০২২-২৩) থেকে (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরে মোংলাবন্দরের অর্জন
২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯৯.০৫ লাখ মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১০৮.৬৮ লাখ মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডলিং করা হয়েছে।

কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে (২০২২-২৩) থেকে (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরে মোংলাবন্দরের অর্জন
২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ২৬ হাজার ৫৮৩ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৩১ হাজা ৪৪ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে।

রাজস্ব আয় (২০২২-২৩) থেকে (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরে মোংলাবন্দরের অর্জন
২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৩০২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। সে রাজস্ব ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দাঁড়য় মোট ৩১৯ কোটি টাকা । পূর্ববর্তী অর্থ বছরের তুলনায় পরবর্তী অর্থ বছরের অর্জিত রাজস্ব আয় ২৮.৫৫% বেড়েছে। 

১.  প্রধান আমদানি পণ্য: খাদ্যশস্য, সার, গাড়ি, এলপি গ্যাস, স্লাগ, লাইম স্টোন, সয়াবিন তেল, জিপসাম, মেশিনারি, কয়লা, পাথর, ক্লিংকার,পামওয়েল, ফ্লুড ওয়েল,ফ্লাই অ্যাশ ইত্যাদি।

২.কন্টেইনারে আমদানি পণ্য: ইলেকট্রনিক্স পণ্য, মোবাইল এক্সোসরিজ, ট্রাইসাইকেল পার্টস, ডাল, ক্যালসিয়াম কার্বনেট,পাটজাতপণ্য,খালি গ্যাস সিলিন্ডার, খেলনা, মেশিনার, রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস, গ্লু এবং মটরপার্টস, লক, উডেন লক ইত্যাদি।

৩.  প্রধান রপ্তানি পণ্য:   গার্মেন্টস, পাট, পাটজাত পণ্য, চিংড়ি, সাদা মাছ, শুকানো মাছ, ক্লেটাইলস, কাঁকড়া, মেশিনারি, কটন ইয়ার্ন ইত্যাদি। এছাড়া মোংলা ইপিজেড হতে বিশ্বের প্রায় ৩৮টি দেশে পণ্য রপ্তানি হয়। রপ্তানিকৃত পণ্যসমূহ হলো যেমন:গার্মেন্টস,কাগজের তৈরি পণ্য, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ব্যাগ, পাটজাত পণ্য, গাড়ির সিট, হিটার,মারবেল টাইলস,হিউম্যান হেয়ার, জিপার, সিগারেট, জ্যাকেট এবং নেট ইত্যাদি।

একনজরে মোংলাবন্দরের জেটি-গুদাম-ইয়ার্ড সুবিধা

১। জেটি ৫টি। প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৮২মিটার

২। ট্রানজিট শেড ৪টি। ধারণক্ষমতা ৩০,০০০ মেট্রিক টন   

৩। স্টাফিং ও আনস্টাফিং শেড ১টি। আয়তন ৪,৭৪৩ বর্গমিটার 

৪। ওয়্যারহাউজ ২টি। প্রতিটির আয়তন ৯৮৬০ বর্গমিটার হিসেবে  মোট ১৯৭২০ বর্গমিটার।

৫। রেফার প্লাগ পয়েন্ট ১৬০টি। রেফার কন্টেইনারে একসঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যায়।

৬। কন্টেইনার ইয়ার্ড ৬টি। আয়তন= ৬৮,৬৬৭ বর্গমিটার। 

৭। কার ইয়ার্ড ২টি। প্রায় ২০০০ ইউনিট গাড়ি সংরক্ষণ করা যায়।

মোংলাবন্দর উন্নয়নে ৫টি প্রকল্প চলমান

১। মোংলাবন্দরের আধুনিক বর্জ্য ও নিসৃত তেল অপসারণ ব্যবস্থাপনা: প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে MARPOL কনভেনশনের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পালন, জাহাজের বর্জ্য সমুদ্রে এবং নদীতে নিক্ষেপ রোধ, সামদ্রিক পরিবেশকে দূষণ থেকে রক্ষা করা যাবে, মোংলা বন্দরে আগত সমুদ্রগামী জাহাজের বর্জ্য দূষণ থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করা যাবে। একইসঙ্গে পশুর চ্যানেল ও মোংলাবন্দরের আশেপাশের নদনদীসমূহের নিঃসৃত তেল থেকে দূষণমুক্ত রাখা সম্ভব হবে।

২। মোংলাবন্দরের জন্য সহায়ক জলযান সংগ্রহ: প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নিরাপদ চ্যানেল বিনির্মাণ, সমুদ্রগামী জাহাজ সুষ্ঠুভাবে হ্যান্ডলিং এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় জরুরি উদ্ধারকার্য পরিচালন করা সম্ভব হবে।

৩। পশুর চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিং: প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মোংলাবন্দরে জেটি পর্যন্ত ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের সুবিধা সৃষ্টি হবে। এতে বন্দরের সক্ষমতা বহুগুণ বাড়বে। 

৪। আপগ্রেডেশন অব মোংলা পোর্ট: প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বার্ষিক ১.৫০ কোটি টন কার্গো, ৩.৫০-৪.০০ লাখ টিইইউজ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। এতে করে বন্দরের কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট শিপিং এজেন্ট, সিএন্ডএফ এজেন্ট, স্টিভেডরিং এবং শ্রমিক শ্রেণির জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

৫। মোংলা বন্দরের ২টি অসম্পূর্ণ জেটি নির্মাণ (পিপিপি এর মাধ্যমে): প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বার্ষিক ১ লক্ষ টিইইউজ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। এতে করে বন্দরের কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিপিং এজেন্ট, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, স্টিভেডরিং এবং শ্রমিক শ্রেণির জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।



আরো পড়ুন