২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর উজানের ঢলের শঙ্কা নিয়ে হাওরে বোরো ধান কাটতেন কৃষকরা। এই বছর বৈশাখ মাসে ফকফকে রোদ। ইতোমধ্যে সব হাওরের ধান কাটা শেষ হয়েছে। এবার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ধান পেয়েছেন সুনামগঞ্জের কৃষকরা। প্রখর রৌদ থাকায় ধান শুকানোর পাশাপাশি গো-খাদ্য খড় সংগ্রহে দিনরাত ব্যস্ত কৃষক পরিবারের লোকজন। জেলায় এবার শত কোটি টাকার খড় সংগ্রহের আশা করছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ। যা হাওরাঞ্চলের ১০ লাখ গবাদি পশুর এক বছরের খাদ্য মজুদ হবে।
কৃষকরা জানান, সুনামগঞ্জ জেলা এখনো হাওরের কৃষির পাশাপাশি গবাদি পশুর ওপর নির্ভরশীল। জেলার কৃষকরা গবাদি পশুর খাবার হিসেবে হাওরের খড় সংগ্রহ করেন। এবার বেশির ভাগ এলাকায় হার্ভেস্টারে ধান কাটা ও মাড়াই করার কারণে সহজে গো-খাদ্য সংগ্রহ করতে পারছেন না কৃষকরা। তাই আলাদাভাবে শ্রমিক দিয়ে খড় সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। এতে বাড়তি অর্থ লাগছে এবং খাদ্য হিসেবে খড় প্রস্তুত করতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলার প্রায় ৪ লাখ কৃষক পরিবার ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে বোরো ধানের চাষাবাদ করেছিল। জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর। প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার উফশী আবাদ হয়েছে। হাইব্রিড ৬০ হাজার ৮০০হেক্টর এবং দেশি ১ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এ বছর প্রায় ১ হাজার হার্ভেস্টার যন্ত্র দিয়ে ধান কেটেছেন কৃষকরা। প্রায় ২ শতাধিক রিপার যন্ত্রও ছিল। হার্ভেস্টার যন্ত্রে দিনে ৩০ বিঘা জমির ধান কাটা ও মাড়াই করা যায় সহজে। তবে এই যন্ত্রের সাহায্যে ধান কাটতে গিয়ে প্রাকৃতিক গো-খাদ্য (খড়) সংগ্রহের কোনো সুযোগ থাকে না।
সুনামগঞ্জ প্রাণিসম্পদ অফিস জানায়, হাওরের ধান কাটা শেষে প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন খড় উৎপাদন হয়। যা এই অঞ্চলের ১০ লাখের বেশি গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই খড়ের মূল্য প্রায় শত কোটি টাকা। প্রাকৃতিক খড় খাইয়ে চাষাবাদের গবাদি পশুকে বর্ষার পুরোটা সময় বাঁচিয়ে রাখেন কৃষকরা। কোনো কারণে হাওরের ফসল ডুবে গেলে গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দেয় হাওরে। গত বছরের এপ্রিলেও পাহাড়ি ঢলে বেশ কয়েকটি হাওরে ফসলহানি ঘটে। এরপর জুন মাসের ভয়াবহ বন্যায় গোলায় রাখা ধানও নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়াও, অধিকাংশ কৃষকের গো-খাদ্য নষ্ট হয়। ফলে গো-খাদ্য কিনে পশুকে বাচিঁয়ে রাখেন তারা।
টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের কৃষক মমিন বলেন, এবার হাওরের ধান কাটা ও মাড়াই সহজ হলেও যন্ত্রে খড় সংগ্রহের কোনো সুযোগ নেই। খড় সংগ্রহ করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। মেশিনে ধান কাটার পর নতুন করে শ্রমিক লাগিয়ে ক্ষেত থেকে খড় সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এতে সময় ও অর্থ অপচয় হচ্ছে এবং খড়ের গুণও থাকছে না।
শনি হাওরের কৃষক শফিক মিয়া বলেন, বৈশাখে ধানের সংগ্রহের পাশাপাশি খড় সংগ্রহ করি উৎসবের মাধ্যমে। এবার এই সুযোগ নেই। যন্ত্রে ধান কাটায় আমাদের খড় সংগ্রহের সুযোগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কিছুই করার নাই, তাই শ্রমিক দিয়ে খড় সংগ্রহ করছি। ধান তোলার কাজ শেষে এবার গো-খাদ্য খড় উত্তোলনে ব্যস্ত সময় পার করছি।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতা তোজাম্মিল হক নাসরুম বলেন, যন্ত্র দিয়ে ধান কাটার ফলে খড় সংগ্রহ করা হাওরের কৃষকের জন্য একটি নতুন সংকট। যাদের গবাদি পশু আছে, তারা গরুর জন্য খড় সংগ্রহ করছেন ধান তোলার পাশাপাশি। এখন হাওর এলাকার কৃষকরা গো-খাদ্য খড় তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আসাদুজ্জামান বলেন, জেলায় ১০ লাখ গবাদি পশু রয়েছে। এ গুলোর বেশির ভাগ খাদ্যই হাওরের প্রাকৃতিক খড়। যা ধান কাটার পর কৃষকরা সংগ্রহ করেন। তবে সুনামগঞ্জে যন্ত্রে ধান কাটায় খড় কিছুটা নষ্ট হয়েছে। তবে শেষ সময়ে দিন ভালো থাকায় কৃষকরা চাহিদামতো খড় সংগ্রহ করেছেন। আরও কয়েক দিন তারা খড় সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাবেন।
সুনামগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, উৎপাদিত ধান থেকে প্রায় ৯ লাখ টন চাল পাওয়া যাবে। যা স্থানীয় চাহিদার ৬ লাখ টন মিটিয়ে আরও ৩ লাখ টনের বেশি চাল উদ্ধৃত্ত থাকবে। এ বছর ফলন ভালো হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রায় কোনো প্রভাব পড়েনি। হাওরে উৎপাদিত ধানের মূল্য প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি।
ঢাকা বিজনেস/এইচ