বার্ধক্য মানব জীবনের একটি অংশ। বেঁচে থাকলে জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে এই বার্ধক্যকে আলিঙ্গন করতে হয়। জীবন সায়াহ্নে এসে জরা, ব্যধি, শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতাসহ নানা প্রতিকূলতা যেন জীবনকে একাকিত্ব ও অসহায়ত্ব করে তোলে। পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি হলেন বটবৃক্ষ সমতুল,সবাইকে সুশীতল ছায়া দিয়ে আগলে রাখেন। তাঁরা হলেন বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ। জীবনের সব ধাপ পার করে অভিজ্ঞতার এক জ্ঞানভাণ্ডার। তাঁদের জীবনে যেমন সাফল্য আছে তেমনি ব্যর্থতাও রয়েছে অনেক। জীবন থকে প্রবীণ অনেক কিছু শিখেছেন। তাঁদের পরিপক্ব অভিজ্ঞতা আর দিকনির্দেশনাই যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মুক্তির বার্তা।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬০ বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদের প্রবীণ কিংবা সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে অভিহিত করা হয়। জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬০ বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিগণ প্রবীণ হিসেবে স্বীকৃত হবেন। দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯। তাঁরা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ, এটা ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন। অথচ ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি অর্থাৎ বিভিন্ন ভ্যাকসিন এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারে রোগ প্রতিরোধ ও সুচিকিৎসা বাড়ছে।
খুবই ক্ষুদ্র পুঁজিতে দুবেলা আহারের ও আর্থিকভাবে একটু মুক্তির আশায় রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে কাজ করে যান। চরম আর্থিক দীনতার মধ্যে পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব করতে করতে জীবনের শেষ অধ্যায় এসে প্রবীণরা হয়ে পড়েন ক্লান্ত।
স্বাস্থ্য সচেতনতা,দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। আমাদের দেশে একদিকে যেমন প্রজনন হার কমছে, তেমনি অন্যদিকে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। এ কারণেই একটা পর্যায়ে গিয়ে এ দেশে বয়স্কদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৪ কোটি। তখন দেশের প্রায় ২০ শতাংশ নাগরিক হবেন প্রবীণ। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পরিণত হবে জাপানের মতো বয়স্কদের সোসাইটিতে। কিন্তু সে সময়ের জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত?
আমাদের সমাজে বৃদ্ধ বয়সের জীবনে যে অসহায় চিত্র ফুটে ওঠে, তা অসহনীয়। প্রথমত বৃদ্ধ বয়সে পরিবারের মধ্যে থেকেও যেন একাকী সময় পার করতে হয়। জীবনসঙ্গী যতদিন বেঁচে থাকেন, ততদিন অন্তত কথা বলার কিংবা শোনার একজন বন্ধু থাকে। তারপর আর এমন বন্ধু মেলে না। আমরা এখন এত ব্যস্ত সময়ের নাগরিক যেন বাবা-মায়ের জন্য কোনো সময় মেলাতে পারি না। সবাই সময়মতো অফিস করতে পারছি, ব্যবসা চালাতে পারছি, ঘরে বসে নিত্যদিনের কাজ রুটিন মাফিক হচ্ছে। কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে একটু সময় কাটাতে পারি না। তাঁরা অসুস্থ হলে তাঁদের নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে পারি না। বাবা-মায়ের সঞ্চয়ের টাকা থেকে ভাগ চাই ঠিকই কিন্তু বাবা-মায়ের হাত দুটো ধরে নিরাপদে ব্যাংকে নিয়ে আসতে পারি না।
শপিংমল ঘুরে হরেক রকম বাজার সাজাতে পারি কিন্তু মা-বাবার কাছে গিয়ে জানতে চাই না, তাঁদের কী প্রয়োজন?তাঁরা অসুস্থ হলে সঠিক ডাক্তারের খোঁজ মেলাতে পারি না কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানাটা খুব সহজেই পেয়ে যাই। সন্তানের অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে অবহেলার কাঠামোগুলোও যেন আলাদা এবং নিষ্ঠুর। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে ওঠার কারণে প্রবীণগণ যেমন নিঃসঙ্গ হয়েছেন, তেমনি পরিবারহীনও হয়ে পড়ছেন। শিক্ষা, চাকরি, বিয়ে,ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কারণেও সন্তানেরা মা-বাবার কাছ থেকে দূরে অবস্থান করছে।
ষাট বছরের পর থেকেই শারীরিক, মানসিক ও আচরণগতভাবে মানুষ দুর্বল হতে থাকে। নির্ভরশীলতা এসে ভর করে। এ সময়ে স্বাস্থ্যগত সমস্যাই যেন মুখ্য। এ বয়সে ডিমেনশিয়া বা বার্ধক্যজনিত বুদ্ধিবৈকল্য, স্মৃতিবৈকল্য, বিষণ্নতা ইত্যাদি নানাবিধ মানসিক সমস্যাসহ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ব্রেইন স্ট্রোক,মেরুদণ্ড ব্যথা এবং নানারকম দৈহিক কষ্টে শেষ জীবন পার করতে হয়। এছাড়া আবেগ, অনুভূতি, বিচারবুদ্ধি, বিবেচনাশক্তি, চিন্তাক্ষমতা, কাজ করার ক্ষমতা সব কিছুই লোপ পেতে থাকে। এজন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা হতে হবে সবার সাধ্যের মধ্যে। ব্যয়বহুল ও দায়সারা সাস্থ্যসেবা প্রবীণদের জীবনকে কখনোই সহজ করবে না। প্রয়োজনে প্রবীণদের জন্য আলাদা হাসপাতাল ও কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে নিয়মিত শরীর চেকআপ,সুস্থ জীবন পালনের নির্দেশনার ব্যবস্থা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে, নিয়মিত হাঁটা, সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা,পরিমিত পানি পান, ভারী কিছু উত্তোলন না করা, মাঝে-মাঝে ঘুরতে যাওয়া,বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করা, ধূমপান বর্জন।
প্রবীণরা আর্থসামাজিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন। এ সময়ে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যান তাঁরা। কারণ এ বয়সে কাজ করে উপার্জন করার সক্ষমতা থাকে না। তাই নির্ভরশীল হতে হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। এরপরও আমরা দেখে থাকি ষাটোর্ধ্ব প্রবীণকে রিকশা চালাতে, রাস্তার ধারে সবজি বিক্রি করতে, বড় একটা ফ্লাক্স হাতে চা বিক্রি করতে। খুবই ক্ষুদ্র পুঁজিতে দুবেলা আহারের ও আর্থিকভাবে একটু মুক্তির আশায় রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে কাজ করে যান। চরম আর্থিক দীনতার মধ্যে পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব করতে করতে জীবনের শেষ অধ্যায় এসে প্রবীণরা হয়ে পড়েন ক্লান্ত।
অবহেলিত ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন প্রবীণদের পাশে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনসহ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকে সহায়তার হাত বাড়াতে হবে। সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিরাও প্রবীণ সমাজের জন্য সহায়ক হতে পারেন। নির্মাণ করতে পারেন হাসপাতাল, প্রবীণ পুনর্বাসন কেন্দ্র।
অনেক সময় সচ্ছল সন্তানের বাবা-মা হয়েও কিন্তু ধর্মীয়, সামাজিক কার্যক্রম, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কিংবা নিজের স্বাধীনভাবে চলাফেরার প্রতিবন্ধকতা থেকে যায়। এর মূল কারণ অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৫৭ লাখ ১ হাজার প্রবীণ ব্যক্তিকে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা আসলে ধনী-দরিদ্র বিবেচনা না করে ১০০ শতাংশে উন্নীত এবং সহজলভ্য করা সময়ের দাবি। কারণ কোনো মা-বাবাই সন্তানদের কাছে হাত পেতে কিছু নিতে চান না। তাদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে রাষ্ট্রের কাছ কাছ থেকে সম্মানসূচক পাওয়া অর্থকে তাঁরা অধিকার হিসেবে দাবি করেন।
প্রবীণদের যে সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে অগ্রাধিকার কিংবা নিয়মিত যেতেই হয়, সেগুলো হলো: ব্যাংক, হাসপাতাল,ধর্মীয় কেন্দ্র। এসব ক্ষেত্রে তাঁদের যাতায়াতের সুব্যবস্থাসহ ওইসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য আলাদা জোন তৈরি করার পাশাপাশি দ্রুত সেবা প্রদানে যত্নশীল হতে হবে। যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা,কিংবা গণপরিবহনে অর্থাৎ বাস,লঞ্চ,ট্রেনে আসন সংরক্ষিত রাখা ও ভাড়ার ক্ষেত্রে মূল্য হ্রাস করা বাঞ্ছনীয়।
২০১৩ সালে ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হয়। ২০১৪ সালে গেজেট হয়েছে, ২০১৫ সালে একটি আইনও প্রণয়ন করা হয়, তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য কোনো আইনি কাঠামো তৈরি করা হয়নি। নাগরিক হিসেবে প্রবীণ ব্যক্তিগণের পূর্ণঅধিকার, সার্বিক, নিরাপত্তা, মর্যাদা, সুস্বাস্থ্য, দারিদ্র্যমুক্ত,মৌলিক মানবাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে এত নির্মল, টেকসই ও শতভাগ প্রবীণবান্ধব ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা’র পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। এত সুন্দর সুগঠিত নীতিমালার প্রয়োগে প্রবীণ সমাজ লাভ করবে সুস্থ জীবন এবং সমাজ তথা রাষ্ট্রে আসবে স্বস্তির নিশ্বাস। অবহেলিত ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন প্রবীণদের পাশে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনসহ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকে সহায়তার হাত বাড়াতে হবে। সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিরাও প্রবীণ সমাজের জন্য সহায়ক হতে পারেন। নির্মাণ করতে পারেন হাসপাতাল, প্রবীণ পুনর্বাসন কেন্দ্র।
দেশের সর্বস্তরের জনগণকে টেকসই পেনশন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে প্রণীত আইন ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কতৃক ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করেছে। অতি সম্প্রতি ১৩ আগস্ট ২০২৩ প্রবীণদের জন্য এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হলো। এই আইনের ধারা ২৯-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে,যা অবিলম্বে কার্যকর হবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার প্রবর্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন কৌশলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
সমাজ ও রাষ্টের কাছে আমাদের অনেক চাহিদা, সুযোগ পেলেই আমরা দোষারোপ করতে দ্বিধাবোধ করি না কিন্তু আমরা কি নিজেকে কখনো প্রশ্ন করেছি কতটুকু আমরা করতে পারছি পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের জন্য? প্রবীণ নাগরিকের সবচেয়ে স্বস্তিময় স্থান হচ্ছে পরিবার। এ কারণে পরিবারে যেন প্রবীণ ব্যক্তিরা মর্যাদার সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করতে পারেন, তার দায়িত্ব সন্তানদের নিতেই হবে। একইসঙ্গে পরিবারের অন্য বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের প্রতিও সমান, শ্রদ্ধা,ভালোবাসা ও মর্যাদা দেখাতে হবে। তবেই বন্ধ হবে বৃদ্ধ বয়সের কান্না।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা