১৫ মার্চ ২০২৫, শনিবার



বিশেষ প্রতিবেদন
প্রিন্ট

যে কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমছে তরল গুড় উৎপাদন

আজহার উদ্দিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া || ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ১০:১২ এএম
যে কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমছে তরল গুড় উৎপাদন


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃষিনির্ভর বিজয়নগর উপজেলায় কয়েক যুগ ধরে তৈরি হচ্ছে তরল গুড়। আখের রস থেকে তৈরি এই গুড় স্থানীয়ভাবে লালী নামে পরিচিত। শীতকালে বিভিন্ন পিঠা-পুলির সঙ্গে মুখরোচক লালী স্বাদে আনে ভিন্নতা। অনেকে আবার মুড়ির সঙ্গে মেখেও স্বাদ নেন লালীর। এ বছর ১ কোটি টাকারও বেশি লালী বিক্রি হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ। গত বছর লালী বিক্রি হয়েছিল ৩ কোটি টাকারও বেশি। কৃষকদের দাবি, আখ চাষে ও শ্রমিকের পেছনে খরচ বাড়ায় লালী উৎপাদন কমেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, খরচ বাড়ছে ঠিকই, তবে উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর, কসবা ও আখাউড়া উপজেলার কিছু এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে আখ চাষ করা হয়। এসব আখের রস থেকে লালী উৎপাদন করেন চাষিরা। চলতি বছর জেলার ২৫ হেক্টর জমিতে চাষ করা আখ থেকে অন্তত ১০০ টন লালী তৈরি হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ। যার বাজারমূল্য ১ কোটি টাকারও বেশি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণপুর, দুলালপুর ও বক্তারমোড়া গ্রামের শতাধিক পরিবার বংশপরম্পরায় বাণিজিক্যভাবে লালী উৎপাদন করে আসছে। প্রতি বছর শীতের শুরুতে লালী তৈরির কাজ শুরু করে পরিবারগুলো। মূলত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলে লালী তৈরি ও কেনাবেচা। প্রতি কেজি লালী বা তরল গুড় খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৫০ টাকায়।

লালী নেওয়ার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন আসছেন বিজয়নগরে। লালীর উৎপাদন কাজ দেখতে রীতিমতো ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। অনেকে লালী নেওয়ার পাশাপাশি আখের রসও খেয়ে যাচ্ছেন।

যেভাবে তৈরি হয় সুস্বাদু লালী বা তরল গুড়

প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে লালী তৈরির কর্মযজ্ঞ। প্রথমেই চলে আখ মাড়াই। মহিষের চোখ ঢেকে ঘানি টানানোর মাধ্যমে আখ মাড়াই করে রস সংগ্রহ করা হয়। এরপর রস জমিয়ে ছাকনি নিয়ে ছেকে রাখা হয় বড় কড়াইয়ে। দুই থেকে তিন ঘণ্টা জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয় আখের রস। এরপর সেই রস লাল রঙ ধারণ করলে নামানো হয় কড়াই থেকে। এভাবেই তৈরি হয় মুখরোচক লালী বা তরল গুড়।

তবে প্রতিবছরই লালী তৈরিতে খরচ বাড়ছে কৃষকদের। এবারের মৌসুমে আখ কাটা এবং মাড়াইয়ের কাজে একজন শ্রমিককে দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হচ্ছে। যা গেলো বছর ছিল ৪০০ টাকা। এছাড়া ঘানি টানানোর জন্য আগে যে মহিষ ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় কেনা গেছে- তা এবার ৩০-৪০ হাজার টাকা বেশি দামে কিনতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন লালী উৎপাদনে জড়িতরা। ফলে খরচের তুলনায় লালী ব্যবসা লাভজনক না হওয়ায় উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছেন তারা।


বিষ্ণপুর ইউনিয়নের ছতরপুর গ্রামের বাসিন্দা বিলকিছ চৌধুরী জানান, প্রতি বছর শীত মৌসুমে তিনি দুলালপুর থেকে লালী কিনে নিয়ে যান। সুস্বাদু এই তরল গুড় তার শ্বশুরবাড়ির সবাই অনেক পছন্দ করেন। বিভিন্ন পিঠার সাথে লালী খেতে অনেক ভালো লাগে বলে জানান তিনি।

দুলালপুর গ্রামের লালী উৎপাদনকারী রুক্কু মিয়া বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ আখ চাষ করতো। কিন্তু দিন দিন আখ চাষির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আখ কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। ঘানি টানানোর জন্য লাখ টাকা বা তার বেশি দিয়ে মহিষ কিনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে লালী তৈরিতে যে খরচ পড়ছে, সে অনুযায়ী দাম পাওয়া যায় না।’

আরেক চাষি সহিদ আকরব বলেন, ‘বংশপরম্পরায় আমি লালী তৈরি করি। তবে ভালো লাভ না হওয়ায় বিগত সময়ের চেয়ে এবার কম জমিতে আখ চাষ করেছি। তাছাড়া সরকারি প্রণোদনাও পাই না আখ চাষে। এজন্য জমিতে এখন লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারাসহ অন্যান্য ফলের চাষ করি।’ এসব ফল চাষ লাভজনক বলে জানান তিনি। 

এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুশান্ত সাহা বলেন, ‘এ বছর ১০০ টনের মতো তরল গুড় উৎপাদন হবে বলে আশা করছি। কিভাবে আখের ফলন বৃদ্ধি করে গুড়ের উৎপাদন বাড়ানো যায়- সে সম্পর্কে কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষকরা আখ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। আখের জমিগুলোতে কৃষকরা লিচু, কাঁঠাল ও পেয়ারার মতো চাহিদা সম্পন্ন ফলের চাষ করছেন।’

ঢাকা বিজনেস/এম 



আরো পড়ুন