১৪ মার্চ ২০২৫, শুক্রবার



আজ উপকূলীয় অঞ্চলে স্বজন হারানোর দিন

তাফহীমুল আনাম, কক্সবাজার || ২৯ এপ্রিল, ২০২৩, ০৫:৩৪ এএম
আজ উপকূলীয় অঞ্চলে স্বজন হারানোর দিন


আজ ২৯ এপ্রিল। সেই ভয়াল দিন। স্বজন হারানোর দিন। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল এক রাতের ঘূর্ণিঝড়েই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।  এছাড়া, গবাদিপশু, হাঁস, মুরগিসহ অন্যান্য সম্পদেরও বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল। দিবসটি উপলক্ষে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন সংগঠন শোকসভার আয়োজন করে।  ২৯ এপ্রিল রাতে মৃতদের স্মরণে মিলাদ মাহফিল, কোরানখানি পাঠের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া মসজিদ, মন্দিরমহ উপাসনালয়গুলোয় বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।  

১৯৯১ সালের এই দিনে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, বাঁশখালী, আনোয়ারা, হাতিয়া,পতেঙ্গা, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, চকরিয়া, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকা। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিমি (১৫৫ মাইল/ঘণ্টা)। তার সঙ্গে ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাস। এই ঝড়ে মৃত্যুবরণ করেন ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন মানুষ। তার চেয়েও বেশি আহত হন। আশ্রয়হীন হয়েছিল কোটি মানুষ।  

মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছিল ২২ এপ্রিল থেকেই। ২৪ এপ্রিল নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়।  ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকে। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল তীব্রতা বেড়ে রাতে আঘাত হানে। এর গতিবেগ পৌঁছায় ঘণ্টায় ১৬০ মাইলে।

তৎকালীন কক্সবাজারের সংসদ সদস্য সাবেক জেলাপরিষদ চেয়ারম্যান মোশতাক আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর আমরা সেখানে গিয়ে মানুষের আহাজারির মধ্যে শুনতে পাই প্যারাবন ধ্বংস হওয়ার কারণে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। তাই এলাকার মানুষের পরামর্শে ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট লাগানো হয়। ধাপে ধাপে এই প্যারাবন লাগানোর কাজ চলছে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে।’  

মোশতাক আহমদ আরও বলেন, ‘১৯৯১ সালের পর ছোট-বড় আরও কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় (যেমন ইয়াশ), কিন্তু যেখানে প্যারাবনের গাছগুলো বড় হয়ে গেছে সেখানে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে, এটা প্রমাণিত। চিংড়ি ঘেরের মালিকরা প্যারাবন কেটে ঘের বানিয়েছে। প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা খরচ করে বাঁধ মেরামত করছে অথচ প্যারাবন দিয়ে ঘেরা জায়গায় কোনো বাঁধ নষ্ট হয়নি।’

চট্টগ্রাম মিরসরাই এলাকার সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘উপকূলের রক্ষাকবচ হচ্ছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। যেখানে যেখানে নিছিদ্র প্যারাবন আছে, সেসব এলাকায় জাগছে নতুন চর। যেখানে প্যারাবন কাটা হয়েছে, সেখানে ভাঙছে উপকূল।’

এলাকার কৃষকরা জানিয়েছেন, এই প্যারাবনে প্রচুর পরিমাণে উলু খেড় (উলু ঘাস) আছে। উলু খেড় (উলু ঘাস) গরু ও ছাগলের জন্য খুব ভালো খাদ্য। কয়েক মাস একাধারে গরু, মহিষ ও ছাগলকে এই ঘাস খাওয়ালে গরু-ছাগল মোটাতাজা হয়ে ওঠে। অন্যান্য ঘাস ও গাছপালা আপনা থেকে গজিয়ে ওঠে। প্যারাবনে প্রচুর পাখি, কাঁকড়া ও মাছ দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে মাছেরা ডিম দেওয়ার জন্য প্যারাবনে চলে আসে। প্যারাবনের ভেতরে ও আশেপাশে প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি মাছ পাওয়া যায়। প্যারাবনের এলাকা মাছের ডিম ছাড়ার জন্যে খুব ভালো জায়গা। এছাড়া, পাতা ও শেকড় মাছের খাদ্য হিসেবেও খুব ভালো।

কক্সবাজারের বাঁকখালী, মহেশখালী আমাবশ্যাখালী, ধলঘাটা, উজানটি, মাতারবাড়ী, শাপলাপুর, বগাচতর, কেরুণতলী, বড়দিয়া, ঘটিভাঙা, তাজিয়াকাটাও সোনাদিয়ার ব্যাপক বা প্রায় ৫ হাজার একর প্যারাবন গত পাঁচ বছরে ধ্বংস করেছে ভূমিদস্যুরা। অথচ গত বছর সোনাদিয়া প্যারাবনে চিতাবাঘ দেখা গেছে।

চট্টগ্রাম উপকূলীয় বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আবদুর রহমান বলেন, ‘আজ নেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল। দিনটিকে স্মরণ করতে গিয়ে বলতে চাই, এই তাণ্ডবের ভয়াবহ ক্ষতি প্রকৃতির কারণে নয়, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ডের কুফল। প্যারাবন ধ্বংস করে যে ডলার এসেছে, তা কি জনগণের কোনো উপকারে লেগেছে? লাগেনি। চিংড়ির ব্যবসাও এখন তেমন রমরমা নয়, কারণ পশ্চিমা দেশে এখন সচেতনতা বেড়েছে, তারা এন্টিবায়োটিক দেওয়া চিংড়ি খাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তারা বলেই দিয়েছে প্যারাবন ধ্বংস করা চিংড়ি খাবো না।’

ড. আবদুর রহমান আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে বন্যা-খরার মতো ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে এবং আমাদের উপকূল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিশ্বে চিহ্নিত হয়ে আছে। অথচ কোনো নীতি-নির্ধারণী আলোচনায় ম্যানগ্রোভ রক্ষার জন্য চিংড়ি ঘের বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ দেখি না।’ 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেও থামানো যাচ্ছে না। ভয়াল ২৯ এপ্রিল যেন আর না আসে সেই চেষ্টা কি আমরা করছি? ঘূর্ণিঝড় ঠেকানো না গেলেও ক্ষয়ক্ষতি তো ঠেকাতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের মতো আর একটি ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস হলে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯টি জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হবে।’

ঢাকা বিজনেস/এইচ



আরো পড়ুন