১৫ মার্চ ২০২৫, শনিবার



চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও শিক্ষকের দায়িত্ব

খুরশীদুজ্জামান আহমেদ || ০৫ অক্টোবর, ২০২২, ০৫:১২ পিএম
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও শিক্ষকের দায়িত্ব


মানবসভ্যতা আগে যেমন ছিল আর বর্তমানে যা আছে, তা এই সভ্যতারই পরিবর্তিত রূপ। আর এই পরিবর্তন বা ক্রমবিকাশের মূলে রয়েছে শিক্ষা। মানবসভ্যতার বিবর্তনের মূলে যেমন শিক্ষার ভূমিকা রয়েছে, তেমনই শিক্ষার বিবর্তনেও মানবজাতির চাহিদার ভূমিকা রয়েছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই শিক্ষা গ্রহণ করে এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটায় ফলে সমাজ এগিয়ে যায়।

 আজ ৫ অক্টোবর। বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশ আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় এই দিনটি পালন করছে। এবারের  প্রতিপাদ্য ‘বিষয়-শিক্ষার রূপান্তর শুরু হয় শিক্ষকদের দিয়ে’।  

১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর প্রথম বিশ্ব শিক্ষক দিবস অনুষ্ঠিত হয় আইএলও ও ইউনেসকোর উদ্যোগে। শিক্ষকদের অবদানের স্বীকৃতির প্রতিফলন হিসেবে প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে। এটি অনিবার্য সত্য যে, মানবসম্পদ সৃষ্টি ও সমাজের উন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকাই সবার আগে। যেকোনো জাতির আলোকবর্তিকা ও প্রেরণার বাতিঘর আমাদের শিক্ষকরাই। একজন শিক্ষক আজীবন দায়িত্ব পালন করেন নিবেদিত হয়ে মানবজাতির সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য। শিক্ষার সূচনা পরিবার থেকে হলেও পূর্ণতা পায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের ছোঁয়ায়। 

 গতানুগতিক শিক্ষার ধারা পরিবর্তন করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সম্ভাবনার লক্ষ্যস্থির করে ২০২৩ সাল থেকে সমগ্র দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হতে যাচ্ছে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে প্রবেশ করেছি আমরা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম প্রধান প্রভাবক হলো মানুষের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি।  AI, রোবোটিক্স, আইসিটি, থ্রি-ডি প্রিন্টিং ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিং অটোমেশনের মতো প্রযুক্তি আমাদের পেশাগত জীবনকে করে তুলেছে গতিময় ও চ্যালেঞ্জিং। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দূরদর্শী উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। মনে রাখতে হবে, অতি আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যখন মানুষের বিকল্প উদ্ভাবন করে, তখন একঘেয়ে, অলস, নির্বোধ মানুষ কর্মক্ষেত্র থেকে ছিটকে পড়ে কর্মহীন হয়ে যায়। এই সময়ই স্বল্পপুঁজির দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যায়। 

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব  প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ জনশক্তিসম্পন্ন দেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনা। তাই দক্ষতার মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার অপার সুযোগ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে জনগণের কী কী দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে নানা আলোচনা চলমান রয়েছে। ২০১৬ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের ৪৬তম সভায় বিশ্বের অন্যতম বিচক্ষণ ও ভিশনারি নেতা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কিত তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। তার চিন্তা-দর্শন নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা চলছে। বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের প্রধান প্রফেসর ক্লস সোয়াব তার লেখা The Fourth Indrustrial Revulation গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা-দর্শন। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিতে হবে চলমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের আভিভাবক তৎপর রয়েছেন। যে অভিভাবক ‘ভিশন-৪১’ দেখতে পারেন এবং রূপরেখা তৈরি করেন, সে অভিভাবক কতটা যুগোপযোগী, আধুনিক ও শক্তিশালী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

একুশ শতকে তথ্য ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোগ্য নাগরিক তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছে সনাতনী পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা। গতানুগতিক শিক্ষার ধারা পরিবর্তন করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সম্ভাবনার লক্ষ্যস্থির করে ২০২৩ সাল থেকে সমগ্র দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হতে যাচ্ছে। যাতে করে শিক্ষার্থীকে টেকসই, কার্যকর সমাধান ও সম্ভাবনাপূর্ণ জ্ঞান, দক্ষতা ও ইতিবাচক দৃষ্টি সম্পন্ন, দূরদর্শী, সংবেদনশীল, অভিযোজন-সক্ষম মানবিক ও যোগ্য বিশ্ব-নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়। সেজন্য আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শক্তিশালী প্রস্তুতি গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এতে দেশের শিক্ষক সমাজ একনিষ্ঠ ও নিবেদিত হয়ে কাজ করে যাবেন।

 এটি সত্য যে, সম্মিলিত চিন্তা ও কর্মোদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জগুলো আমরা মোকাবিলা করতে পারি।

শিক্ষার্থীকে সফল মানবসম্পদে পরিণত করতে জ্ঞান অর্জনের জন্য জ্ঞানগত দক্ষতার প্রয়োজন, আবার মূল্যবোধ চর্চার জন্য মনোসামাজিক আবেগীয় দক্ষতারও প্রয়োজন। একইসঙ্গে ব্যবহারিক ও আবেগীয় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য জ্ঞানার্জন ও মূল্যবোধের  চর্চা খুবই জরুরি। অতএব এসব দক্ষতার বিষয়ে শিক্ষকদের সবসময় নিরলস ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিশীল হলেই শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তন, সমস্যা সমাধান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্ব-ব্যবস্থাপনা, সহযোগিতামূলক, যোগাযোগ, জীবিকায়ন ও ডিজিটাল লিটারেসির মতো দক্ষতা অর্জন সহজ হবে। শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠবে বিশ্ব নাগরিক। 

তবে উল্লিখিত সব দক্ষতা অর্জনে পর্যাপ্ত সংখ্যক নেতৃত্বগুনসম্পন্ন, পেশাদার, দায়িত্বশীল ও নিবেদিত শিক্ষক দরকার। কেননা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার অগ্রে থাকেন শিক্ষক। এই কারণে শিক্ষককেই আধুনিক, যুগোপযোগী শিখন-শেখানো পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দায়িত্বজ্ঞান ও সততার সঙ্গে অর্পিত কার্যাবলি এগিয়ে নিতে পারার পরিবেশ সৃষ্টি,  শিক্ষকের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ শিক্ষক যেন সামাজিক দুর্বলতার প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেন, তা কর্তৃপক্ষের নিশ্চিত করা দরকার। গবেষণায় শিক্ষকদের বৃত্তির ব্যবস্থা, ক্যাডারভিত্তিক পদায়ন; সর্বোপরি শিক্ষা জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক ব্যবধানকে ঘুচিয়ে আনা অনিবার্য।  

পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানিতে শিক্ষকদের রাখা হয় সবচেয়ে মর্যাদার আসনে। এছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়ায়, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ভারত, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। এই সব দেশের উদাহারণ ও আর্থ-সামজিক কাঠামো পর্যালোচনা করে বলা যায়, যেসব সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা বেশি, সেখানে সমৃদ্ধ শিক্ষার্থীও বেশি। 

কোভিড-১৯-এর সংকট স্পষ্ট করেছে, শিক্ষকরা হলেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ইঞ্জিন। যাদের ছাড়া প্রতিটি শিক্ষার্থীকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সঙ্গত ও মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া অসম্ভব। এই অতিমারি কেবল শিক্ষা খাতের জন্যই নয় বরং আমাদের সামগ্রিক ভঙ্গুরতা ও আন্তঃসংযুক্ততা সম্পর্কে সচেতন করেছে। এটি সত্য যে, সম্মিলিত চিন্তা ও কর্মোদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জগুলো আমরা মোকাবিলা করতে পারি। পরিবর্তন, উন্নয়ন ও একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য আজকের এই মহান শিক্ষক দিবসে ঐক্যবদ্ধ হওয়া অনিবার্য। সফল হোক বিশ্ব শিক্ষক দিবস।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, লালমনিরহাট জেলা শাখা



আরো পড়ুন