চলতি বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে চলছে কৃষকের শ্রমে-ঘামে জমিতে ফলানো সোনার ধান গোলায় তোলার উৎসব। এই উৎসবে কৃষক পরিবারের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু সবাই অংশ নিয়েছেন। জেলার ছোট-বড় ১৩৭টি হাওরে ধান কাটা প্রায় শেষের দিকে। ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে।
তবে, শেষ সময়ে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা পড়েছেন কিছুটা দুশ্চিন্তায়। আগামী ৩ মে হাওর এলাকায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায়, হাওড় এলাকার ফসল রক্ষায় বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে কৃষি বিভাগ। এতে কিছুটা আতঙ্কে রয়েছেন হাওরাঞ্চলের কৃষকরা।
আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী ৩ মে থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওড় এলাকায় (সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনা) ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায়, হাওড় এলাকার ফসল রক্ষায় বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে কৃষি বিভাগ।
নিদের্শনা মতে বোরো ধান ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হয়ে গেলে দ্রুত সংগ্রহ করে নিরাপদ ও শুকনো জায়গায় রাখতে বলা হয়েছে। এছাড়া দ্রুত পরিপক্ব সবজি সংগ্রহ, কলা ও অন্যান্য ফসল এবং সবজির জন্য খুঁটির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।
পাশাপাশি কৃষি জমির নিষ্কাশন নালা পরিষ্কার, ধানের জমিতে পানি জমতে না দেওয়া, জমির আইল উঁচু করা, ফসলের জমি থেকে অতিরিক্ত পানি সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা রাখতেও কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টির সময় সেচ, সার ও বালাইনাশক না দেওয়া এবং বৃষ্টির পর বালাইনাশক প্রয়োগেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস এর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তাহিরপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ হাসান-উদ-দৌলা। তিনি বলেন, ‘আমরা আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়ার পরপরই কৃষকদের এই তথ্য জানিয়েছি। পাশাপাশি ৮০ ভাগ ধান পরিপক্ব হলে কাটার জন্য আমিসহ আমাদের কৃষি কর্মকর্তারা পরামর্শ দিচ্ছেন। আশা করছি, ৩-৪ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ ধান কাটা শেষ হবে।’
সম্প্রতি কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা ফসল ঘরে তুলতে দিন-রাত এক করে কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন। কেউ ধান কাটছেন, কেউ আঁটি বাঁধছেন। কেউ কেউ সেই ধান মাথায় নিয়ে ক্ষেত থেকে বাড়ি যাচ্ছেন। আবার কেউ করছেন মাড়াইয়ের কাজ। সকাল থেকে দিনভর এভাবেই ব্যস্ত সময় পার করছেন সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের চাষিরা।
তবে সোনালি ধান ঘরে তোলার পরও কৃষকের মুখ যেন মলিন হয়ে আছে। কারণ ধানের ফলন ভালো হলেও সার, কীটনাশক, ধান কাটা শ্রমিকসহ অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয়েছে। খরচের তুলনায় ধানের দাম কম। ফলে ধানের দাম না বাড়লে লাভ তো দূরে থাক, এই দামে উৎপাদন খরচও উঠবে কি না, তা নিয়েই শঙ্কায় কৃষক।
হাওর পাড়ের কৃষকরা জানান, সবকিছুর যে দাম তাতে ধানের দাম ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকার নিচে হলে কৃষকের লস। যেভাবে খরচ হয়, তাতে কৃষকের বেঁচে থাকা সম্ভব না।
তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের কৃষক রুবেল মিয়া বলেন, ‘এই বছর ধানের আবাদ করতে অন্যান্য বছর থেকে বেশি খরচ হয়েছে। সেই তুলনায় দাম আরও বেশি নির্ধারণ করলে ভালো হতো।’
মাটিয়ান হাওরের কৃষক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এই বছর হাওরে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। কৃষকরা হাসিমুখে ধান ঘরে তুললেও ধানের দাম নিয়ে শঙ্কায় আছেন কৃষকরা। সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করেছে সেই দামে কৃষকরা দান বিক্রি করতে পারছেন না।’
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ১৩৭টি ছোটবড়ো হাওরে বোরোচাষে জড়িত প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার চাষী পরিবার। এবার হাওরে বোরোচাষ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর। এর মধ্যে ৭০.০৫ ভাগ উফশী (উচ্চ ফলনশীল ধান), ২৯ ভাগ হাইব্রিড ধান ও ০.০৫ ভাগ স্থানীয় প্রজাতির দেশি ধান আবাদ হয়েছে। গতকাল ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত কর্তন হয়েছে প্রায় ২৪ হাজার হেক্টর। যা চাষাবাদের প্রায় সাড়ে ১৭ ভাগ।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে হাওরে ধান কাটতে ৮৭০টি কম্বাইন হার্ভেস্টর ও ২০০টি রিপার যন্ত্রের সঙ্গে রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক। প্রতিদিন গড়ে একটি হার্ভেস্টর ১শ জন শ্রমিকের ও রিপার ২০ জন শ্রমিকের ধান কাটতে পারে। কৃষি বিভাগের মতে হাওরে ১ লাখ ৯০ হাজার নিয়মিত কৃষিশ্রমিক, ৩০ হাজার অনিয়মিত শ্রমিক ও বাইরের জেলার আরো প্রায় ১০ হাজার শ্রমিকসহ প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিকও ধান কাটছেন। সর্বশেষ তথ্য মতে জেলায় ৭০ ভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে।
কৃষি বিভাগ আরো জানিয়েছে, এবার হাওরে বিআর ২৮, ২৯ বীজ দেওয়া হয়নি সরকারিভাবে। তাই হাওরে ৮৯, ৯৬, ৮৮, ৯২, বঙ্গবন্ধু-১০০ ধানের আবাদ হয়েছে বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন প্রকৃতি এভাবে ১৫দিন অনুকূলে থাকলে হাওরের শতভাগ জমির ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। হাওরের পুরো ধান কৃষক গোলায় তোলতে পারলে গত বারের চেয়ে এবার আরো ১১০ কোটি টাকার বেশি ধান উৎপাদিত হবে। গত বছর ৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৪৯ মে.টন চাল উৎপাদিত হয়েছিল। এবার ৯ লক্ষ ১৩ হাজার মে. টন চাল উৎপাদিত হবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘যথাসময়ে বৃষ্টি পাওয়ায় এবারও বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই গতবারের চেয়ে এবার উৎপাদনমূল্যও বেশি হবে। শ্রমিকের সংকট নেই। ধান কাটাও শেষ পর্যায়ে, আশা করছি ৩ মে এর মধ্যেই ৯০ শতাংশ ধান কাটা সম্পন্ন হবে।’
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন,‘দ্রুত সময়ের মধ্যে কৃষকেরা যেন হাওরের ফসল নির্বিঘ্নে গোলায় তুলতে পারেন, এ জন্য যা যা করা দরকার, জেলা প্রশাসনসহ কৃষি কর্মকর্তারা কাজ করছেন।’
/ঢাকা বিজনেস/এনই/