একটি মৃত্যুর অভাবে


রনি রেজা , : 07-04-2024

একটি মৃত্যুর অভাবে

প্রশস্ত রিসেপশনের এক কোণায় গুঁটিসুটি মেরে নাক চেপে ধরে বসে আছেন দেশের প্রখ্যাত কবি অমলেন্দু ঠাকুর। দু’একজন আড়চোখে দেখছে তাকে। কেউ চিনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। মুখে মাস্ক পরা অবস্থায়ও ওভাবে নাক চেপে ধরায় হয়তো অবাক হয়ে তাকানো। তার আগমনের সংবাদ ডা. আফরোজাকে দেয়া হয়েছে। অ্যাসিসট্যান্ট এসে চায়ের অফার করেছে, তিনি না করে দিয়েছেন। এমন সম্মানী মানুষকে এভাবে বসিয়ে রাখতে সঙ্কোচ হচ্ছে। ভেতরে একজন রোগী আছে। বেশি ঝামেলাপূর্ণ। তাকে দেখা হলেই অমলেন্দু বাবুকে ভেতরে পাঠানো হবে। অতটুকু ধৈর্য্যও ধরতে ইচ্ছে করছে না। বসে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। 

সময় যত গড়াচ্ছে গন্ধটা তীব্র হচ্ছে। নাড়িভুড়ি ঠেলে বমি আসার উপক্রম। লাশটা যেন ক্রমে কাছে আসছে। তার ওপর চেপে বসছে। গত কয়েকদিন ধরে এই গন্ধটা তাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে। মনে হচ্ছে ক্রমে তার দিকে একটা লাশ আসতে থাকে। এরপর ঘিরে ধরে তাকে। ক্রমে লাশটা পচে, গলে, খসে খসে তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কিংবা সব সময় পচা লাশের মাংসের একটা টুকরা তার নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে অদৃশ্য সুতায়। সেখান থেকে গোবড়ে পোকারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গাঢ় গন্ধ বের করছে প্রতিনিয়ত। সময় যত যায় গন্ধটা তত তীব্র হয়। তীব্র হতে হতে এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যান অমলেন্দু বাবু। জ্ঞান ফেরার পর আর গন্ধটা থাকে না। খানিকক্ষণ বাদে আবার শুরু হয় একই কায়দায়। 

মাসখানেক আগে একটা বেসরকারি টেলিভিশনের টক-শোতে অংশ নিতে গিয়ে প্রথম গন্ধটা টের পান অমলেন্দু ঠাকুর। এর আগেও হয়তো এসেছে, খেয়াল করেননি বা পাত্তা দেননি। আশপাশের কিছুর গন্ধ হবে ভেবে পাশ কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু টেলিভিশনটির স্টুডিওতে যখন শো চলছে, অমলেন্দু বাবু শক্ত শক্ত যুক্তিতে যখন অপর বক্তাকে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন অবস্থা; ঠিক তখনই বুঝতে পারেন গন্ধটা তীব্র হচ্ছে। গন্ধের তীব্রতায় কথা আর বেশি আগায় না। গলার কাছে থাকা কিছু ঝেড়ে, বাকিটা জুসমিশ্রিত হুইস্কির মতো কৎ করে গিলে ফেললেন। আরো অনেক কথা পেটের মধ্যে রেখেই বক্তব্য ছাড়তে হয় তখনকার মতো। কোনোরকম দম আটকে বিজ্ঞাপন বিরতির অপেক্ষা করতে থাকেন। বিরতি আসতেই উপস্থাপককে বললেন এয়ার ফ্রেশনার দিতে। শো শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তেই এয়ার ফ্রেশনার দেওয়া হয়েছে যদিও। তবু প্রোডাকশন সহকারীকে ডেকে আরেকবার দেওয়ানোর ব্যবস্থা করা হলো। এতেও গন্ধটা যাচ্ছিল না। তার ভেতর তৈরি হওয়া অস্বস্তি ভাব উপস্থিত অন্য অতিথিরাও বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু অন্যরা কোনো গন্ধ না পাওয়ায় পাত্তা দেননি। তিনিও কোনোমতে সেদিনের শো শেষ করে বেরিয়ে পড়েন। 

তখন পর্যন্ত গন্ধটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। তবে বাইরে বেশিক্ষণ থাকতে পারতেন না। গন্ধটা তাড়া করতো বেশ। এজন্য অনেক অনুষ্ঠান, টক-শো, মিটিং বাদ দিতে হয়েছে। প্রথমদিকে কিছু কিছু অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে কোনোমতে নিজের বক্তব্য শেষ করেই বিদায় নিয়ে চলে আসতেন। কিন্তু এখন বেরই হতে পারেন না। প্রথম প্রথম গন্ধটা ইঁদুর মরা পর্যায়ের থাকলেও ধীরে ধীরে তা মানুষ পচার চেয়েও তীব্র হয়েছে। খ্যাতি আসার পর রকেটগতিতে ছুটে চলা জীবনে এই প্রথম হোঁচট খেতে হলো অমলেন্দু ঠাকুরকে। চারদিকে অনেক আহ্বান থাকতেও কোথাও যোগ দিতে পারছেন না। এমন এক বিশ্রী রোগ, কাউকে বলতেও পারছেন না। মিডিয়ার ডে অবস্থা, একটু ক্লু পেলেই মুহূর্তে রাষ্ট্র করে দেবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো আছেই। কী সব কেচ্ছা রটাবে কে জানে! এতসব ভেবেই একপ্রকার আত্মগোপনে আছেন তিনি। চিকিৎসার জন্যও নামকরা সব ডাক্তারের দপ্তর ঘুরেছেন গোপনে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শেষে এক ডাক্তারের পরামর্শেই ডা. আফরোজার কাছে আসা। সেই ডাক্তারই এখানে ফোন করে দিয়েছেন। এজন্য আলাদা কোনো সিরিয়াল দিতে হয়নি। তাছাড়া কবি, বুদ্ধিজীবী হিসেবে অমলেন্দু ঠাকুরের অনেক যশ-খ্যাতি। তাকে চেনে না এমন সচেতন মানুষ এ রাষ্ট্রে আছে বলে মনে হয় না। 

এরপর সেই বিখ্যাত লেখকের কাছে নিজের বাসনার কথা জানালে তিনি একটা পত্রিকায় ফোন করে বলে দেন। সেখানে প্রকাশও হয় কিছু লেখা। ওতে যেন ইচ্ছের পারদ আরো জ্বলে ওঠে। 

সিরিয়াল দিতে না হলেও তিনি উপস্থিত হওয়ার আগে যিনি চেম্বারে ঢুকে পড়েছেন তাকে তো বের করে দিয়ে দেখবেন না। তাকে দেখা পর্যন্ত সময়টুকু তো অপেক্ষা করতে হবেই। কিন্তু দেখতে দেখতে অনেক সময় পার হয়ে গেল। একজন রোগী দেখতে তো এত সময় লাগার কথা না। কী করছে ভেতরে? অস্থির হয়ে ওঠেন অমলেন্দু ঠাকুর। না, এভাবে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। তাছাড়া এত অপেক্ষা তার সঙ্গে যায় না। জীবনের কঠিন বাঁক, প্রতিবন্ধকতা ঠেলে এই পর্যায়ে এসেছেন তিনি। এই সফলতা, যশ, খ্যাতি; এসব তো এমনি এমনি হয়নি। এর জন্য এক দীর্ঘ অপেক্ষা, কঠিন সাধনা রপ্ত করতে হয়েছে তাকে। সাপলুডুর মইয়ের মতো কোনো সুগম পথ তার জন্য প্রস্তুত ছিল না। যাদের জন্য প্রস্তুত থাকে তাদেরও সঠিক সময়ে সঠিক মইটা চিনে নিতে হয়। অথবা প্রস্তুত করার মানুষ থাকতে হয় পেছনে। অমলেন্দু বাবুর ছিল না কোনোটিই। যা ছিল তা কেবল বড় কিছু হওয়ার বাসনা। এজন্য যতটা একাগ্রতা থাকা দরকার তা-ও ছিল। ছিল পরিশ্রমও। সবার যেমন থাকে, তারচে আলাদাই বলা যায়। 

বন্ধুরা যখন পিথাগোরাসের সূত্র মুখস্ত করতে ব্যস্ত থাকতো তখন অমলেন্দু ঠাকুরের সময় কাটতো ডেল কার্নেগির সফল হবার ১০১ উপায় পড়ে। কলেজে পড়াকালীন সময়ে কিছুদিনের জন্য জড়ান ছাত্ররাজনীতিতে। অল্পদিনে বুঝে ফেলেছেন এতে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। এদেশে এমপির ছেলেই এমপি হবে, চেয়ারম্যানের ছেলে চেয়ারম্যান। তাছাড়া অমলেন্দু ঠাকুর মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের ছেলে। তার পরিবারের আধিপত্য বা বাবা-দাদার অত টাকাপয়সাও নেই খরচ করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হবে। পরিচয় দেওয়ার জন্য যতটুকু প্রয়োজন তা এরই মধ্যে অর্জন হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে টিউশনি করাতে হতো টিকে থাকার দায়ে। নিজের ক্লাস, টিউশনি করানো, হলে থাকার জন্য দলীয় সমাবেশে সময় দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে তার দৃষ্টি ছিল কিভাবে বড় হওয়া যায়! এসময় তার টিএসসিতে ঘোরাঘুরি বৃদ্ধি পায়। অল্প দিনেই আবিষ্কার করেন কবিদের আড্ডা। এটাকেই তিনি টার্গেট হিসেবে নেন। 

প্রথমদিকে ভয়ে ভয়ে তাদের কাছাকাছি যেতেন, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব রক্ষা করতেন, তবে কান খাড়া করে রাখতেন। কবিতা বিষয়ক আলোচনা শুনতেন। রপ্ত করার চেষ্টা করতেন। সুযোগ বুঝে দু’একজনের সঙ্গে পরিচিত হতেন। তাদের সঙ্গে চলতো কবিতার তালিম। একদিন নিজে কিছু একটা লিখে এক উঠতি কবিকে দেখালেন। তিনি বেশ উৎসাহ দিলেন। ধীরে ধীরে তার কবিতা লেখার ঝোঁক কয়েক গুণ বেড়ে গেল। মিশে একাকার হয়ে গেলেন কবিদের সঙ্গে। রাত-বিরাত কবিতার খাতা নিয়ে বের হয়ে যান রুম থেকে। কখনো বারান্দার কোণায়, কখনো খোলা আকাশের নিচে বসে রচনা করতে থাকেন কবিতা। প্রায় দিনই কবিতা শেষ না করেই ভোর করে দিতেন। কাটাকুটি হিজিবিজিই শেষ অব্দি থাকতো। নির্ঘুম রাত পার করে শেষে কিছু কাটাকুটি কাগজ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতো তাকে। 

যেদিন বা কিছু একটা হবে হবে ভাব, সেদিনই সারা দুনিয়ার ঘুম এসে ভর করে তার চোখে। সকাল হলেই কোচিং, ক্লাস, টিউশনি... নানা ঝামেলা-ঝক্কি। দিনে তো ঘুমানোর সময় হয় না। তাই ওই রাতেই কবিতা লেখা অথবা ঘুম; একটাকে বিসর্জন দিতে হয়। তবু তিনি হাল ছাড়েন না। তিনি ঘুমকেই বিসর্জন দিতেন। যেদিন পেরে উঠতেন না, সেদিনও খাতা-কলম জড়িয়ে ধরেই ঘুম যেতেন। একটি কবিতাও যেদিন হয়ে উঠতো সেদিনই উপভোগ করতেন স্বর্গীয় সুখ। মনে হয়, এ সুখের কাছে জগতের বাকি সব কিছু তুচ্ছ। যদিও তাতে খুব বেশি আগায় না। মাসে তিন-চারটার বেশি কবিতা জমা হয় না পাণ্ডুলিপিতে। তবে ওতেই তিনি তৃপ্ত হন। কবিতায় সুখ খোঁজেন। কবিতাই তার ধ্যান-জ্ঞ্যান। এই জগতেই তার সব বন্ধু-স্বজন। তখন শাহবাগ, টিএসসি, হাকিমচত্বরে কেবল তিনি কবিদেরই দেখতে পান। 

চারদিকে গিজগিজ করছে। তিনি কবে যেন শুনেছিলেন, ‘এই শহরে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি।’ তার মনে হচ্ছে, এই শহরে যে ক’টা কাক আছে তারচে বহুগুণ বেশি কবি রয়েছে কেবল এই শাহবাগ, কাটাবন, আজিজ মার্কেট, টিএসসি আর হাকিমচত্ত্বরেই। এত কবির মধ্যে বিখ্যাত হওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। তার ওপর প্রথম প্রথম উৎসাহ দিলেও তখন সমালোচনাই করে অধিকাংশ। এরই মধ্যে সমসাময়িক অনেক কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। নানাজন নানা পরামর্শও দেন। এর মধ্যেই এক প্রতিষ্ঠিত লেখক পরামর্শ দেন গদ্যে নজর দিতে। গদ্য লেখক খুব বেশি নেই। এদিক কিছুটা ফাঁকা আছে। তার পরামর্শে শুরু করে দেন গদ্য লেখা। এর মধ্যে চুপি চুপি কয়েকটি পত্রিকার এড্রেসে ইমেলও করেছেন কিছু লেখা। একটি লেখাও কোথাও ছাপা না হওয়ায় হতাশ হন কিছুটা। এরপর সেই বিখ্যাত লেখকের কাছে নিজের বাসনার কথা জানালে তিনি একটা পত্রিকায় ফোন করে বলে দেন। সেখানে প্রকাশও হয় কিছু লেখা। ওতে যেন ইচ্ছের পারদ আরো জ্বলে ওঠে। 

তুমি ক্ষমতার মোহে অন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত জীবিত ছিলে। তখনই যদি তোমার দৈহিক মৃত্যু ঘটতো তুমি অমর হতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য হলো, সঠিক সময়ে একটি মৃত্যুর অভাবে তুমি পচে গেলে

এরপর যখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে চাকরি জীবনে প্রবেশ করেছেন। বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। তখন বদলেছে জীবনের রুটিন। কিন্তু কবিতা লেখার নেশা ছেড়ে যায়নি। নিয়মরক্ষার সব চালিয়েছেন বটে, বেশি ভালোবাসা ছিল সাহিত্যের প্রতিই। স্ত্রীর নরম শরীরের চেয়েও বেশি টানতো সাহিত্যের খাতা। গভীর রাতে লাশের মতো পড়ে থাকা স্ত্রীর শীতল দেহ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অতি সন্তর্পণে গিয়ে বসতেন সাহিত্য রচনায়। অফিসের পার্টিতে যোগ না দিয়ে সোজা বাসায় চলে আসতেন কবিতা লিখবেন বলে। বৌ-বাচ্চা যখন শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যেতেন তিনি এই ইট-পাথরের শহরে থেকে যেতেন সাহিত্য রচনা করবেন বলে। একটু একা হলে হয়তো কিছু একটা লেখা হবে। হয়েছেও। এখন তাকে ঘিরেই আলাদা বলয় তৈরি হয়েছে। যে পত্রিকাগুলোয় লেখা ছাপতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে তারাই এখন লাইন দিয়ে থাকে লেখা নেয়ার জন্য। 

টেলিভিশনগুলো তাকে নিয়ে একটি টক-শো করাতে পারলে ধন্য হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও তার সরব উপস্থিতি। আমলাদের সাথেও সখ্যতা বেশ। সমীহ করেন বড় বড় রাজনীতিবিদরা। তারই কিনা ডাক্তারের চেম্বারে এসে বসে থাকতে হচ্ছে এভাবে! পাছে কেউ চিনে ফেলার ভয়। বিরক্তি নিয়ে ইশারায় আরেকবার ডাকেন ডাক্তারের অ্যাসিসট্যান্টকে। এবার ডাক পড়ে অমলেন্দু বাবুর। ভেতরে সুনশান নীরবতা। তিনি জানেন, উকিল আর ডাক্তারের কাছে কিছু লুকাতে নেই। বাঁচতে হলে সত্যিটা বলতেই হবে। অন্যায় করেও উকিলকে সত্যটা বললে কোনো না কোনো ফাঁকফোঁকর বের করবেনই। আর ডাক্তারকে গোপন রোগের কথা না বললে নিরাময় পাওয়া সম্ভব না। তাই ডাক্তার আফরোজা কোনো প্রশ্ন করার আগেই এক দমে সবটা বলে দেন অমলেন্দু বাবু। যা যা জিজ্ঞাসা করতে পারেন এবং জিজ্ঞাসা করবেন না এমন সব বিষয়ই বলেন। এই এক মাসে তিনজন ডাক্তার পরিবর্তন করে চতুর্থতম হিসেবে ডাক্তার আফরোজার কাছে আসা। 

প্রাথমিক জিজ্ঞাসা মুখস্ত হয়ে গেছে। টেস্ট রিপোর্টও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ডাক্তার আফরোজা অবাকই হলেন। সব রিপোর্ট দেখে এবং সবিস্তার শুনে কিছুটা চিন্তিত হন ডাক্তার আফরোজা। একজন ভালো সাইকিয়াটিস্টিক দেখানোর পরামর্শ দেবেন ভাবছেন। কিন্তু তিনি ব্যাপারটা সহজভাবে নিবেন কিনা বোঝার চেষ্টা করছেন ডাক্তার আফরোজা। দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার আগেই অমলেন্দু বাবু বলে ওঠেন, ‘তা-ও দেখানো শেষ। আমার মানসিক কোনো সমস্যা নেই। গন্ধটা আপনি পাচ্ছেন না? এত বিশ্রী গন্ধও কারো নাকে লাগছে না? সবার নাসিকা শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে বোধয়। গন্ধ দেবতা সবার শক্তি নষ্ট করে দিয়েছে। বুঝতে পেরেছি আপনাকে দিয়েও কিচ্ছুটি হবে না। সব ভুয়া। সব ভুয়া...।’ বলতে বলতেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। 

ডাক্তার আফরোজা ঘাবড়ে গেলেও প্রাথমিক চিকিৎসা দিতেই সুস্থ হয়ে ওঠেন অমলেন্দু ঠাকুর। তার পরিবারের লোকজনকে খবর দেয়া হলে এসে গাড়িতে করে নিয়ে যায় বাসায়। এরই মধ্যে তার অসুস্থতার খবর জানাজানি হয়ে গেছে। কয়েকটি টেলিভিশন ব্রেকিং চালাচ্ছে। এখন তিনি মোটামুটি সুস্থ। নিজের কক্ষে শুয়ে শুয়ে চ্যানেল পরিবর্তন করছেন। প্রায় প্রতিটি চ্যানেলেই ব্রেকিং চালাচ্ছে তার অসুস্থতার খবর। বিরক্ত হন তিনি। বিরবির করে বলেন, ‘সব মূর্খদের হাতে চলে গেল! একজন কবি, বুদ্ধিজীবী অসুস্থ, এটাও নাকি ব্রেকিং নিউজ। মারা গেলে তোরা কী চালাবি?’ তবে কিছুটা ভালোও লাগে। ছাপার অক্ষরে যেদিন প্রথম নিজের নাম দেখেছিলেন, সেদিন রাতে চোখের পাতা দুটিকে এক করতে পারেননি। আনন্দে কেঁদেই ফেলেছিলেন। 

টেলিভিশন স্ক্রিনে এক ঝলক নিজের চেহারা দেখানো কিংবা স্ক্রিনে নিজের নাম দেখা তো ছিল স্বপ্নের ব্যাপার। সেই অমলেন্দু ঠাকুর একটু অজ্ঞান হওয়াতে প্রায় সবগুলো টেলিভিশন ব্রেকিং চালাচ্ছে। অমলেন্দু বাবু বড় হয়েছেন বটে। বড় হওয়ার বাসনা থাকলেও এত বড় হবেন, তা কি কখনো ভেবেছিলেন অমলেন্দু ঠাকুর? তিনি না ভাবলেও তার একাগ্রতা দেখে স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক সুশীল স্যার ঠিকই বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘একদিন অনেক বড় হবি। সব সময় শোভিত হবি ফুলের মালায়। তবে মনে রাখতে হবে, মালারও জ্বালা আছে।’ 

ইদানীং সুশীল স্যারের কথা একটু বেশিই মনে পড়ছে। মালার জ্বালা কি তবে এই? একটু অসুস্থ হওয়া যাবে না। ডাক্তারের চেম্বারে মুখ খুলে বসা যাবে না। পার্কে নিজের মতো করে হাঁটা যাবে না। কয়েকদিন আগে স্কুল জীবনের এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হলো। সুশীল স্যার নাকি পাগল হয়ে গেছেন। মানুষের গোপন সব কথা বলে ঝগড়া বাঁধান গ্রামে। কেউ তার জন্য শান্তিতে থাকতে পারছে না। গ্রামের সম্মানিত মানুষগুলোকেও কীসব বলে বলে বেইজ্জতি করেন। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো লেগে আসতে চায়। সম্ভবত ডাক্তার আফরোজার দেওয়া ঘুমের ওষুধের কার্যকারিতা শুরু হয়েছে। কী আশ্চর্য, আধো ঘুমের মধ্যেই তিনি স্পষ্ট দেখতে পান, সুশীল স্যার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ান অমলেন্দু বাবু। এগিয়ে কদমবুচি করতে যান, অমনি বাঁধা দেন সুশীল স্যার। ‘বলেন, তুমি আমাকে ছুঁয়ো না। আমি যে অমলকে চিনি, তুমি সে নও। তুমি এখন অনেক বড় কবি। বুদ্ধিজীবী। অনেক বড় হয়েছে বটে। বড় হতে হতে তুমি পচে গেছ।’

এমন কথা শুনে কেঁপে ওঠেন অমলেন্দু ঠাকুর। সুশীল স্যার বলতে থাকেন, “যতদিন তুমি সাহিত্যকে ভালোবেসে রচনা করেছ, বিবেকের তাড়নায় সৃজনশীল কাজ করেছ, সমাজের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে লিখেছ, অন্যায়ের বিপক্ষে কলম ধরেছ; ততদিন তুমি সম্মানিত হয়েছ। সাপলুডুর অদৃশ্য মই তোমার সামনে ঠিকই ছিল। প্রথম দিকে তোমার যে সাধনা করতে হয়েছে, ওটা সবারই করতে হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তুমি অনেক দ্রুত সফলতা পেয়েছ। কিন্তু মনে রাখনি, ‘মালারও জ্বালা আছে’। তুমি যেদিন থেকে আপস করতে শুরু করেছ, বেছে বেছে উদ্দেশ্যমূলক লিখতে শুরু করেছ সেদিনই তোমার সত্যিকার মৃত্যু হয়েছে। এরপর তুমি ক্রমে পচে চলেছ, বুঝতে পারোনি। আজ তুমি যে গন্ধরোগে ভুগছ। তোমাকে যে গন্ধ তাড়া করে, তা বাইরের কোনো গন্ধ নয়। তোমার পচে যাওয়ার গন্ধ। অন্য কেউ টের না পেলেও তুমি টের পাও। তীব্রতায় জ্ঞান হারাও। তুমি ক্ষমতার মোহে অন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত জীবিত ছিলে। তখনই যদি তোমার দৈহিক মৃত্যু ঘটতো তুমি অমর হতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য হলো, সঠিক সময়ে একটি মৃত্যুর অভাবে তুমি পচে গেলে।”


উপদেষ্টা সম্পাদক: সামছুল আলম
সম্পাদক:  উদয় হাকিম
প্রকাশক: লোকমান হোসেন আকাশ



কার্যালয়: বসতি অ্যাসোসিয়েটস (সি-৩), প্লট- ০৬,
ব্লক- এস ডব্লিউ (এইচ), গুলশান এভিনিউ, গুলশান-১, ঢাকা।
মোবাইল: ০১৭১৫১১৯৪৪৪,
ইমেইল: [email protected]