‘মৃত্যুর কিছুক্ষণ পর আলতামাশের হঠাৎ মনে হলো, কোনো একটা স্বপ্নের ভেতর থেকে জেগে উঠেছে সে। কিন্তু স্বপ্নটা এতটাই বাস্তব ছিল যে সেই স্বপ্নের ঘোর কিছুতেই কাটাতে পারছে না। তার বুকের কাছে একটা তীব্র ব্যথা। হাঁটুর কাছটাতেও। ট্রেনটা কী অবিশ্বাস্য গতিতেই না তার শরীরের ওপর দিয়ে ছুটে চলে গেল! সে হাত বাড়িয়ে তার বুকের ব্যথার জায়গাটা স্পর্শ করতে চাইল। কিন্তু পারল না। বিস্মিত আলতামাশ তাঁর ক্ষতবিক্ষত হাঁটু জোড়া দেখার জন্য নিচে তাকাল। আর সঙ্গে সঙ্গেই আতঙ্কে কিংবা আনন্দে জমে গেল সে। দেখল, খানিক আগে যে ট্রেনটা তার শরীরের ওপর দিয়ে চলে গেছে, সেই শরীরটা ওখানে ট্রেন-লাইনের ওপর ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। অথচ সে বেঁচে আছে! তাঁর এত দিনের স্বপ্ন তাহলে পূরণ হয়েছে? সে বেঁচে থেকেই তাঁর নিজের বিকৃত মৃত শরীরটা দেখতে পাচ্ছে? কী আশ্চর্য!’ পড়ছিলাম ঔপন্যাসিক সাদাত হোসাইনের ‘বিভা ও বিভ্রম’ উপন্যাসটি।
উপন্যাসের অন্যত্র দেখা যাচ্ছে, ‘বিভ্রান্ত, বিচলিত আলতামাশ ভেবে পেল না সে কী করবে? তবে তাঁর ইচ্ছা হচ্ছিল তীব্র এক চিৎকারে ঘুমন্ত এই পৃথিবীকে জাগিয়ে তুলতে। আজ এই পৃথিবীতে তার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই। অবশেষে সে সত্যি সত্যিই তার সেই আরাধ্য অলৌকিক জীবন, অবিশ্বাস্য ক্ষমতাটা পেয়ে গেছে!’ দু’জায়গায় একই চরিত্রের বিপরীত চিত্র, তাই না? এ জন্যই উপন্যাসের নাম ‘বিভা ও বিভ্রম’। লেখকও ভূমিকায় বলেছেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই অদ্ভুত কল্পনার জগৎ পাল্টেছে। সেখানে হয়তো কখনো কখনো বাস্তব এবং কল্পনা মিলেমিশে যায়। হয়ে যায় অন্য কোন জগৎ। সেই জগৎ আসলে কীসের? বিভার, নাকি বিভ্রমের? এই উপন্যাস সেই বিভা ও বিভ্রমের অনুসন্ধান।’
তবে উপন্যাস পড়া শুরু করলে পাঠকেরও বিভ্রম হতে পারে। সেটি হচ্ছে, তিনি কি হুমায়ূন আহমেদের কোনো উপন্যাস পড়ছেন? চরিত্র, বর্ণনা, কল্পনা, জাদুবাস্তবতা, পরাবাস্তবতা—পুরোটাই যেন হুমায়ূন আহমেদ। নাকি এটি পাঠক হিসেবে আমার ভ্রম? আমি কি খুব বেশি হুমায়ূন আহমেদ পড়েছি? খুব বেশিও না আবার কমও না। তাতেই তুলনামূলক মিলটা ধরতে পারলাম। আমি যতই পড়ছি, ততই হুমায়ূন আহমেদের কোনো চরিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
রাস্তার টং দোকান থেকে ঢকঢক করে পানি খাওয়া। দোকানিকে নিজের নাম জিজ্ঞাসা করা। দোকানির সোজা উত্তর, ‘আপনের নাম জানব কেন?’ এরপর নিজের নাম নিজেই বলা। নামের অর্থসহ তরজমা করাসহ যাবতীয় কাজ হিমু, মিসির আলীর চরিত্রের সঙ্গে মিশে আছে। ফলে পাঠক হিসেবে বিভ্রম হওয়াটা দোষের নয়। লেখকের কলম থেকেই তুলে ধরছি, ‘‘আলতামাশ আরও একদলা থুতু ফেলল। তারপর দোকানির হতভম্ব চোখ উপেক্ষা করে নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল। তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। ইন্টারভিউ বোর্ডে ঢুকতেই কুঁতকুঁতে চোখের ফরসা চেহারার লোকটা ঠোঁট বাঁকা করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঠোঁটের কোণায় বিদ্রুপাত্মক হাসি ঝুলিয়ে টেনে টেনে বলল, ‘তো আপনার নাম আলতামাশ?’’ এমন অদ্ভূতুরে চরিত্র চোখের সামনে এলেই চোখ বন্ধ করে হুমায়ূন আহমেদের কথা ভাবতে হয়। এটি সাদাত হোসাইনের দোষ বা গুণ কোনোটিই আমি বলছি না। তবে পাঠ্যবইয়ের মতো টেবিলে টেবিলে যখন হুমায়ূন আহমেদের বই পৌঁছে গেছে; সেখানে ‘বিভা ও বিভ্রম’ বইয়ের মলাটে লেখকের নাম বাদ দিলে অনায়াসেই পাঠকের বিভ্রম হতেই পারে।
সে যা-ই হোক, এবার বইয়ের কথায় আসি—আসলে বিভা অর্থ ‘সৌন্দর্য’, ‘কিরণ’ কিংবা ‘দীপ্তি’। আর বিভ্রম অর্থ ‘ভ্রান্তি’। বইয়ের প্রধান চরিত্র আলতামাশের না আছে সৌন্দর্য, না আছে দীপ্তি। তবে ভ্রান্তিতে তিনি নোবেল পাওয়ার যোগ্য। উপন্যাসের নায়ক আলতামাশের মতো কুৎসিত মানুষ জগতে আর হয় না। পড়তে পড়তে এই চরিত্রের ওপর আমার বিরক্তি ধরে গেছে। এর জন্য অবশ্য লেখক বাহবা পেতেই পারেন। তবে আমাদের নিজস্ব একটি জগৎ থাকে। সেই জগতে সব সময়ই বাস্তবের সব নিয়ম কাজ করে না। তবুও সাদাত হোসাইনের ‘বিভা ও বিভ্রম’ উপন্যাসটিও আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন তুলে ধরে। তা হলো—বিশ্রী রকমের এমন জীবন দ্বারা তিনি কী বোঝাতে চাইলেন? মোর্যাল অব দ্য স্টোরিটা কী? কোনো পাঠক আলতামাশের ওপর আস্থা তো রাখবেনই না। বরং যত দ্রুত চরিত্রটির পতন বা প্রস্থান কামনা করবে।
আলতামাশ ছাড়াও আরেকটি কেন্দ্রীয় চরিত্র ফারিয়া। যিনি আলতামাশের ফুফাতো বোন, প্রেমিকা কাম স্ত্রী। ফারিয়াকেও খুব মহৎ ভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি লেখক। দুটি চরিত্রের কোনোটির ওপরই আমার মায়া জন্মায়নি। উপন্যাসের আয়তন খুব বেশি না হলেও হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনার অবতারণা হয়নি। হয়তো পাঠক হিসেবে এই ব্যর্থতা আমার। কেননা আমি শুরুতেই চরিত্রগুলোকে অন্য লেখকের সৃষ্ট চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করে ফেলেছি। ফলে এখানে যতই মায়াঘন পরিবেশের অবতারণা লেখক করতে চেয়েছেন, আমার কাছে তা নিতান্তই ন্যাকামি মনে হয়েছে। আলতামাশের মতোই ফারিয়ার স্বভাব, ব্যক্তিত্ব, আগ্রহ জাস্ট গতানুগতিক হয়ে উঠেছে। চিরাচরিত রুপা, পার্বতী কিংবা রাজলক্ষ্মীর মতোই।
এবার একটু মৌলিক তথ্য দিয়ে রাখছি বইটি সম্পর্কে। যে তথ্য জেনে রাখাও পাঠকের কর্তব্য বলে মনে হচ্ছে। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের ‘দৈনিক প্রথম আলো’র ঈদ সংখ্যায়। এরপর ২০২১ সালের বইমেলায় (মার্চ) বইটি প্রকাশ করে ‘প্রথমা প্রকাশন’। এ বছর বইমেলার প্রথমার স্টল থেকে উপন্যাসটি কিনেছি আমি। তাতে জানলাম, প্রথম মুদ্রণই এখনো শেষ হয়নি। আমার জানামতে, লেখকের অন্যান্য বই বইমেলা শুরুর আগেই চতুর্থ মুদ্রণে চলে যায়। এটার ক্ষেত্রে বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে। বইয়ের দামও হাতের নাগালে। ফলে একবছর পর বইটির দশম মুদ্রণ আসতেই পারতো। তবে এক মুদ্রণে আটকে থাকলেও বইটি কিন্তু ‘কালি ও কলম পুরস্কার’ অর্জন করে নিয়েছে। শুনে এসেছি, বাংলাদেশে পুরস্কার পাওয়া বই কম বিক্রি হয়। কারণ বইগুলো নাকি ক্লাসিক সাহিত্য হয়ে যায়। মৌলিক এ তথ্যগুলো একজন পাঠক হিসেবে আপনাকেও জানিয়ে রাখলাম।
এবার ফেরা যাক বিভা ও বিভ্রমের জগতে। লেখক বইটির চরিত্র চিত্রণে খুব বেশি দূরে যেতে পারেননি। একটি বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। বৃত্তের বাইরে যাওয়ারও চেষ্টা করেননি। চরিত্ররা সবাই আমাদের পরিচিত। লেখক হয়তো বলেছেন, বইটি লেখা হয়েছে চারপাশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা নিয়ে। তাই এর প্রতিটি চরিত্রের জটিলতা, আক্ষেপ, জিঘাংসা, অনুশোচনা, হতাশা, ব্যর্থতা—সবই মানবজীবনের অংশ।
আলতামাশ নামটি শুনতে অদ্ভুত লাগলেও মূল চরিত্র তিনিই। শুরুতেই একথা আপনাদের জানিয়েছি। বলতে গেলে উপন্যাসটি এই অদ্ভুত নামের মানুষটিকে ঘিরেই লেখা হয়েছে। এই নামের জন্য তাকে হেনস্থা হতে হয়। তাই নিজের নাম নিয়েও আলতামাশ খানিকটা বিরক্ত। শুধু নিজের নাম নিয়েই নয়। তিনি আসলে চারপাশের সবকিছু নিয়েই বিরক্ত। ফলে কাহিনি যত এগিয়েছে, পাঠক হিসেবে আমিও তত বিরক্ত হয়েছি। বইটির নাম তাই ‘বিরক্ত’ হলে বেশি উপযুক্ত হতো। তার শৈশব-কৈশোর আর দশটা বাংলা সিনেমার মতো। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের অন্যত্র বিবাহ। সৎফুফুর সংসারে অত্যাচার-নির্যাতন। চিরায়ত বাঙালি কাহিনি নয় কি? তিনি চাইতেন, আলতামাশ তার বাড়ি ছেড়ে চলে যাক। কিন্তু আলতামাশের মনে কখনো এমন ভাবনা আসেনি।
এখানে আলতামাশ চরিত্রটিকে একটি ট্রমার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছেন লেখক। শৈশব-কৈশোরের দুঃস্মৃতি আলতামাশকে সব সময় তাড়া করেছে। ফলে আলতামাশের মনে নানা রকম মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা ভর করেছে। আলতামাশ নিজের চারপাশের বেশিরভাগ মানুষকে বিশ্বাস করেন না। প্রবল বিশ্বাসহীনতা আলতামাশের দৈনন্দিন জীবনকে একরকম বিষিয়ে তুলেছে। যে কোনো ব্যাপারেই তার মনে হয়, কেউ বুঝি তার সাথে প্রতারণা করবে। এই ভয়ে স্বাভাবিক সম্পর্কও অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। নিজের স্ত্রীকেও বিশ্বাস করতে পারেন না। সন্দেহের বানে বিদ্ধ করতে করতে ফারিয়ার মনকেও বিষিয়ে তোলেন।
সব মিলিয়ে বিভা ও বিভ্রম একটি বড় গল্প হতে পারতো। উপন্যাস হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনেক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। হরিহরণের মিষ্টির দোকান, ধেড়ে উঁদুর, শপিংমল, স্বপ্নে উড়ে যাওয়া, কল্পনায় মায়ের সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি বেশ কয়েকবার বর্ণিত হয়েছে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের নাটককে টেনেটুনে সিনেমা বানানোর মতো অবস্থা হয়েছে। মূল যে কাহিনি, তা অনায়াসেই বলে ফেলা যায়। বইয়ের ঊনআশি পৃষ্ঠায় যখন দেখি, ‘বরং খুব সূক্ষ্ম কিন্তু তীব্র ওই ইচ্ছেপূরণের অপেক্ষা আর আক্ষেপ নিয়েই মৃত্যু হলো তার।’ উপন্যাসটি এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। এমনকি শেষ করাও যেত। পড়তে পড়তে পাঠক হিসেবে আলতামাশের প্রতি আমার যে বিরক্তি এসে গেছে, তাতে আর পৃষ্ঠা উল্টানোর ইচ্ছা জাগেনি। তবু শেষ করার ব্রত নিয়ে বসেছিলাম বলে শেষ করতে বাধ্য হলাম। আত্মহত্যার পরের অংশটুকু অনেকটা জোর করেই পড়তে হলো। উপলব্ধি করলাম যে, সেখানে মৃত আলতামাশ অলৌকিক ক্ষমতা পেয়ে সব কিছু দেখছে চুপিচুপি। নিজের যাবতীয় ইচ্ছাপূরণ করছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছাপূরণ গল্পের মতো করে। তবে কল্পনায় মৃত্যু হলেও ঘুম ভাঙার পর আলতামাশ বাস্তবেই ফিরে এসেছিলেন।
স্বপ্নভঙ্গের পরে মনে হলো, সিনেমা দেখলাম। বরাবরই যেটা হয়। তবে আলতামাশের আত্মহত্যাই যৌক্তিক ছিল। একধরনের অসুস্থতা নিয়েই তার স্বেচ্ছামৃত্যু হতে পারতো। কিন্তু লেখক সাদাত হোসাইন তার কেন্দ্রীয় চরিত্রকে মহৎ করে তুলতে চেয়েছেন। তবে এ কথা ভাবেননি যে, সব চরিত্র চাইলেই মহৎ হতে পারে না। পরিবর্তিত হয়েও আলতামাশ আমার মনে শিহরণ জাগাতে পারেননি। চিকিৎসাবিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞানের কোনো অবতারণা নেই। অলৌকিকভাবেই একটা মানুষ বদলে গেল। তাও আবার রাতে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। একজন পাঠক হিসেবে আমার এটাই মনে হয়েছে। কারণ লেখক শুরু থেকেই চরিত্রটিকে এমনভাবে নির্মাণ করেছেন তিলে তিলে, যা হুট করে এক রাতের স্বপ্নে আমূল বদলে যেতে পারে না। উপন্যাসের ব্যর্থতা হয়তো এখানেই। এ ছাড়া উপন্যাসের পরতে পরতে অতিকথন বেশ পীড়া দিয়েছে। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি, একই ঘটনার পুনর্বিবরণ কেবল সময়ক্ষেপণ করেছে। এমনকি পাঠকের কাছে লেখকের এত এত প্রশ্ন বিরক্তির কারণও হতে পারে। যেমন ফারিয়া কি পারবে? সত্যিই পারবে? সে কি উঠে দাঁড়াবে? নাকি আকাশে উড়বে—এমন ধরনের প্রশ্ন।
ফারিয়ার ব্যাপারে আলাদা করে আর বলার কিছু নেই। আলতামাশ যেমন জটিল, তার চেয়েও বেশি জটিল ফারিয়া। জঠিল অঙ্ক কষতে কষতে লেখক ত্রিকোণমিতির সূত্র মেলানোর চেষ্টা করেছেন। ফারিয়ার মধ্যে না আছে মায়া, না আছে ভালোবাসা। নিজের জেদের কাছে সবকিছুকে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তবে চরিত্রটি আত্মনির্ভরশীল। কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। নিজের জন্যই। নিজের বিজয়ের জন্য। ফারিয়ার প্রাপ্তি আসলে কী? এক ফোটা জল? যার জন্যই অপেক্ষায় ছিল এতটা বছর। সেই জল কি বৃষ্টির নাকি চোখের?
মূল দুটি চরিত্র ছাড়াও গল্পের প্রয়োজনে চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে। তবে আফরোজা বানু ও রায়হান ছাড়া আর কোনো চরিত্র বেশি দাগ কাটতে পারেনি। এ ছাড়া আর যেসব চরিত্র রয়েছে, তাদের আসলে বিশেষ কোনো ভূমিকাও ছিল না। বলতে গেলে, বিভা ও বিভ্রম মূলত আলতামাশের মনস্ত্বাত্ত্বিক জটিলতারই গল্প। ফারিয়ার প্রতি আলতামাশের তীব্র ভালোবাসা দেখা গেলেও আলতামাশের মাঝে তীব্র সন্দেহবাতিকতাও চোখে পড়ে। এতে ধীরে ধীরে দুজনের সম্পর্কও বাঁধা পড়তে থাকে নানা সমস্যায়। লেখক বলেছেন, ‘যেন সূক্ষ্ম এক সুতোয় ঝুলে থাকে বয়ে না বেড়াতে পারা ভারী এক সম্পর্কের বোঝা।’
আলতামাশের মধ্যে অডিটরি হ্যালুসিনেশনের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যে কি না নিকটজনের অভাব অনুভব করতে করতে এক সময় আপন মনেই সেই মানুষটির কথা শুনতে পান। তার মনে হয়, মানুষটি তার সাথে কথা বলছেন। একপর্যায়ে আলতামাশও তার সাথে কথা বলা শুরু করেন। এ ছাড়াও আলতামাশের মধ্যে ডিলিউশন ও আংশিক ডিলিউশন দেখা যায়। মূলত তার সন্দেহবাতিকতা আর জীবনভর একটি বিশেষ ক্ষমতা ও বিশ্বাসের পিছে ছুটতে থাকা ছাড়া বিশেষ কোনো ক্ষমতা নেই। লেখক বলেছেন, ‘সে তার জীবনটা এক অদ্ভুত অলৌকিক স্বপ্নে বিভোর হয়ে নষ্ট করেছে।’ অপরদিকে ছোটবেলায় ভোগ করা ট্রমার কারণে তাকে একদম যুবক বয়সেও নানা রকম ‘স্ট্রেস’ ও ‘প্যানিকড’ হতে দেখা যায়। আলতামাশের জীবনের সব সমস্যার মূলে আসলে ‘পিটিএসডি’।
আমি সাদাত হোসাইনের যতগুলো উপন্যাস পড়েছি, তার মধ্যে বিভা ও বিভ্রমকে সবচেয়ে দুর্বল বলে মনে হয়েছে। তার আরশিনগর, অন্দরমহল, মানবজনম, নির্বাসন যেমন অন্তরে দাগ কেটেছিল। সে হিসেবে বিভা ও বিভ্রম দাগ কাটা তো দূরের কথা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও বলবো, আমার কাছে যা তিক্ত, আপনার কাছে তা অমৃত মনে হতেও পারে। তাই পড়ার অনুরোধ রইল। আমি বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি। লেখকের জন্যও শুভকামনা রাখছি।