ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের হ্যালোসিন খোলা বাজারে বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগকারীরা বলছেন, একটি অসাধুচক্র ‘অপারেশনের রোগীর চেতনানাশক ওষুধ হ্যালোসিনের’ বোতলের লেভেল পরিবর্তন করে খোলা বাজারে চড়া দামে বিক্রি করছে। আর ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বিষয়টি তাদের জানা নেই। প্রমাণ পেলে জড়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসিআই হেলথ্কেয়ার লিমিটেড এই হ্যালোসিন উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি তারা এই চেতনানাশক ওষুধটি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এরই সুযোগে একটি অসাধু চক্র ঢামেক হাসাপাতাল থেকে হ্যালোসিন বাইরে এনে চড়া দামে বিক্রি করছে।
এসিআই হেলথ্কেয়ার লিমিটেড-এর বিপণন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০ এমএলের হ্যালোসিন তারা দুইভাবে বাজারজাত করতো। বেসরকারি হাসপাতালের জন্য সরবরাহ করা বোতলটির লেভেলের রঙ ছিল সাদা ও সবুজ। আর লাল ও সবুজ রঙের বোতলে ২০০ এমএল হ্যালোসিন সরবরাহ করে আসছিল সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু প্রায় ১০ মাস ধরে তারা বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে হ্যালোসিনের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। কাঁচামালের সংকটের কারণে ওষুধটি তারা আর বাজারজাত করতে পারবে না বলে উল্লেখ করে। তারা ঘোষণা দেয় নতুন ফর্মুলা বাজারে আনবে। আর নতুন ফর্মুলা বাজারে আনা পর্যন্ত বিকল্প চেতনানাশক ব্যবহারেরপরামর্শ দেয় কোম্পানিটি।
এসিআই হেলথ্কেয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মহিবুজ জামান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে দেশের সব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়, ‘পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বে শুধু একটি কোম্পানি হ্যালোথেন এপিআই (একটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট) তৈরি করতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য নতুন চেতনানাশক ব্যবহারের কারণে হ্যালোথেনের চাহিদা বিশ্বব্যাপী ধারাবাহিকভাবে কমে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান না হওয়ায় হ্যালোথেন নামের চেতনানাশক ওষুধটির একমাত্র প্রস্তুতকারক উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে হ্যালোথেন বিশ্বে আর বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যাবে না। এ কারণেই বাংলাদেশে এসিআই হেলথ্কেয়ার লিমিটেড হ্যালোসিন উৎপাদন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।’ এতে আরও বলা হয়, তারা শিগগিরই নতুন ফর্মুলা বাজারে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হ্যালোসিন চেতনানাশক ওষুধ। তাই তারা এর সরবরাহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। একটি হাসপাতালে যত অপারেশন হতো, ঠিক তার বিপরীতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক হ্যালোসিনই এসিআই সরবরাহ করতো। সাধারণ কোনো ফার্মাসিতে সরবরাহ করতো না। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা হ্যালোসিনগুলো ‘নানাউপায়ে’ দেশের দুটি বড় সার্জিক্যাল ও মেডিসিন মার্কেট ‘মিডফোর্ট’ ও ‘বিএমএ মার্কেট’ ছাড়াও বড় বড় হাসপাতালকে ঘিরে গড়ে ওঠা ফার্মেসিগুলোতেও কমবেশি বিক্রি হতো। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১ হাজার ৫০৫ টাকা হলেও কখনো কখনো রোগীর স্বজনদের ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকাও গুনতে হতো। ফলে অধিক লাভের আশায় কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজসে এই হ্যালোসিন মজুদ করে। এরপর চড়া দামে বিক্রি করে।
রাজধানীর শাহবাগ, মিটফোর্ড শ্যামলী ও উত্তরার কয়েকজন ওষুধ ব্যবসায়ী জানান, বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতালগুলের বেশিরভাগেরই হ্যালোসিনের মজুদ শেষ হয়ে গেছে। ফলে তারা বিভিন্ন উপায়ে এই চেতনানাশকটি সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
উত্তরা লেকভিউ স্পেশালাইজড হসপিটালের ম্যানেজার মোস্তফা কামাল বলেন, ‘হ্যালোসিন এমন অপরিহার্য একটি চেতনানাশক, যা ছাড়া হ্যালোথিনবিডি নামক অজ্ঞান করার যে মেশিন রয়েছে, সেটিও কাজ করবে না। মেশিন কাজ না করলে রোগীকে অজ্ঞান করা যাবে না। ফলে সংশ্লিষ্টরা চড়া দামে এই হ্যালোসিন সংগ্রহ করছেন। আর সাময়িক এই সংকটের সুযোগ নিচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চক্র।’
এসিআই হেল্থকেয়ার লিমিটেডের বিপণন বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘কাঁচামালের (হ্যালোথেন) সংকটের কথা ভেবেই সরকারি হাসপাতালে লাল ও সবুজ রঙের বোতলে পর্যাপ্ত হ্যালোসিন সরবরাহ করা হয়েছিল। সেই পর্যাপ্ত মজুদ থেকেই অসাধু চক্রটি বিক্রির জন্য নিষিদ্ধ হলেও হ্যালোসিন বাইরে পাচার করছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ফার্মাসি ব্যবসায়ী এই প্রতিবেদককে জানান, এই লাল ও সবুজ রঙের হ্যালোসিনের বোতল রাজধানীতে ঢামেক হাসপাতালের স্টোর থেকে বিভিন্ন কৌশলে বাইরে বিক্রি হয়। বিক্রির পর অসাধু ব্যবসায়ীরা উৎপাদন ও মেয়াউত্তীর্ণের তারিখসহ প্রয়োজনীয় তথ্য ঠিক রেখে লাল ও সবুজ রঙের লেভেল পরিবর্তন করে ফেলে। এরপর বেসরকারি হাসপাতালের জন্য সরবরাহ করা সাদা ও সবুজ রঙের লেভেল নিজেরা বানিয়ে হ্যালোসিন বোতলে লাগিয়ে দেয়। যেন কোনো প্রমাণ না থাকে যে, এটি ঢামেক হাসপাতালের জন্য নির্ধারিত ওষুধ।
তারা আরও জানান, অসাধু চক্রটির তৎপরতা রাজধানীর শাহবাগ, শ্যামলী, উত্তরা ও মিটফোর্ডে বেশি। সরকারি হ্যালোসিনগুলো রাজধানীতে কেবল ঢামেক হাসপাতাল থেকেই পাচার হচ্ছে। গত জুন মাস থেকে ব্যাপকহারে হ্যালোসিন পাচার হয় বলেও তারা জানান।
এ বিষয়ে ঢাকা বিজনেস-এর এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করলে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘এমনটা ঘটার কথা নয়। যদি এই ধরনের অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে কেউ জড়িত থাকে, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
/ঢাকা বিজনেস/এনই/