‘খুব আগ্রহ নিয়ে বন্ধ পাঠাগারের সামনে দাঁড়ালাম। খোলার পর দেখা গেলো পাঠাগারের বারান্দায় ৫০-৬০টি সিমেন্টের বস্তা রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, শ্যালো মেশিন, কয়েকটি রঙের বালতি ও পাইপও রাখা হয়েছে বারান্দায়। এগুলো ঠেলে সামনে এগোতেই নাকে ভেসে আসলো তীব্র গন্ধ। ইঁদুর মরে পচে যাওয়ার গন্ধ। আর মাথা আটকে গেলো মাকড়সার জালে।’ এমন অভিজ্ঞতা হলো সোনাতলা উপজেলা সাধারণ পাঠাগারে গিয়ে।
পাঠাগারের ভেতরে প্রবেশের পর দেখা যায়, লাইব্রেরিয়ানের টেবিল-চেয়ার। টেবিলের ওপর ময়লায় মোড়ানো কয়েকটি পেপার ও ধুলোবালি আর মাকড়সার জাল। দেখে মনে হয় না যে গত কয়েক বছরের মধ্যে খোলা হয়েছে এই লাইব্রেরি। বই পড়ার টেবিলে ধুলোর আস্তরণ ও কয়েকটি চেয়ার, যা সম্পূর্ণ বসার অনুপোযোগী। বুক সেলফগুলোতে বই থাকলেও তাতেও ঝুলছে তালা।’
বগুড়ার সোনাতলায় ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘উপজেলা সাধারণ পাঠাগার’। প্রায় ৩৩ বছরের পুরনো এ পাঠাগারটি উপজেলা চত্বরের ইউএনওর বাসভবনের সামনে অবস্থিত। এই পাঠাগারে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজারের মতো বই।
দেখা যায়, উপজেলার এ পাঠাগারটি চরম অবহেলা ও অযত্নে রয়েছে। তালা দেওয়া গেটের ভেতর থেকেই দেখা যায় ভেতরের দৃশ্য। পাঠাগার ভবনের বারান্দার গেটে তালা দেওয়া থাকলেও ভেতরে ঢোকার গেট একদম খোলা। দরজা দিয়ে দেখা গেলো ভাঙাচোরা চেয়ার আর ধুলোয় জমানো বুক সেলফ। জানালাগুলোরও পাল্লা খোলা। জানালার ভেতর দিয়ে তাকাতেই মনে হয় ভুতুড়ে বাড়ি।
পাঠাগারে প্রবেশের অনুমতি চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাঈদা পারভীন বলেন, ‘চাবি রয়েছে বাসভবনের দায়িত্ব পালন করা আনসার সদস্যর কাছে।’
আনসার সদস্যকে চাবির কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘চাবি আমার কাছে নেই। আছে মিস্ত্রির কাছে।’ কোন মিস্ত্রির কাছে জিজ্ঞাস করলে বলেন, ‘ইউএনও স্যারের বাসভবন নতুনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানকার কাজ যে মিস্ত্রিরা করছেন, তাদের কাছে।’
মিস্ত্রির কাছে চাবি থাকার কারণ জানতে চাইলে ওই আনসার সদস্য বলেন, ‘ওই নির্মাণাধীন বাসভবনের মালামাল রাখা হয়েছে লাইব্রেরির ঘরে। এ জন্য তাদের কাছে চাবি রয়েছে।’
আনসার সদস্য বলেন, ‘আপনি স্যারের কাছ থেকে অনুমতি নিন, আমি মিস্ত্রির কাছ থেকে চাবি এনে পাঠাগার খুলে দিচ্ছি।’
স্থানীয়রা জানান, কয়েক বছর আগেও এখানে নিয়মিত পাঠকদের আড্ডা হতো। প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকতো পাঠাগারটি। পাঠকরা বিভিন্ন রকমের বই-পত্রিকা পড়তেন। কিন্তু আজ এর পরিস্থিতি দেখে বোঝার উপায় নেই।
সিজুল ইসলাম নামের এক পাঠক ও সাংস্কৃতিককর্মী জানান, ‘আমি ২০০৮-০৯ সালের দিকে ছাত্রাবস্থায় উপজেলা পাঠাগার এবং বিজ্ঞানাগারে নিয়মিত যেতাম। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে অল্প বিস্তর জেনেছি ওখানকার বই পড়েই।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ঈদে বাড়ি গিয়ে দেখলাম পাঠাগারটি এখন মৃতপ্রায়। কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা এবং অবহেলার কারণে এটি হয়েছে বলে মনে করি।’
আলী জামান নামে আরেকজন পাঠক বলেন, ‘পাঠাগারটি জাতীয় গ্রন্থাগারের নিবন্ধনভুক্ত। প্রতিবছর বই কেনার জন্য এখানে বরাদ্দ আসে। তবে নতুন বইতো আমরা পাঠাগারে দেখি না। গত বছরেও প্রায় ৫১ হাজার টাকা বরাদ্দ এসেছে। জানি না তাও কোন অজানা কারনে পাঠাগারটি বন্ধ রয়েছে।’
পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারি নাজির আখতার কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ রফিকুল আলম বকুল বলেন, ‘আমি পাঠাগার কমিটিতে ছিলাম। তা প্রায় সাত-আট বছর আগের কথা। এখন আমার তেমন মনেও নেই। কমিটি এখনও আছে কি-না তা আমি জানি না। তবে দীর্ঘদিন ধরে পাঠাগারটি বন্ধ রয়েছে, তা জানি। আর এইটা সোনাতলা পাবলিক পাঠাগার না, এইটা উপজেলার পাঠাগার। এটা চালু করা, এটা সংস্কার করা বা এর ব্যয়ভার মিটানোর ব্যবস্থা করা সব ইউএনওসহ প্রশাসন করবে। আমিও চাই পাঠাগারটি দ্রুত সচল করা হোক।’
এই অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাঈদা পারভীন বলেন, ‘আমি যোগদানের পর থেকে দেখছি পাঠাগারটি তালাবদ্ধ। বর্তমানে পাঠাগারে কোনো লাইব্রেরিয়ান নেই। এজন্য কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। আশাকরি খুব দ্রুত লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ ও পাঠাগারটি সংস্কার করে পুর্ণাঙ্গ কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
ঢাকা বিজনেস/এইচ