ট্রেন্ট নদীর পাড়ে শখের সওদাগর


উদয় হাকিম, নটিংহ্যাম (যুক্তরাজ্য) থেকে , : 26-05-2023

ট্রেন্ট নদীর পাড়ে শখের সওদাগর

ইউরোপ আমেরিকার গ্রাম কেমন; এটা নিয়ে কৌতূহল সবার। বাংলাদেশে যেমন আমরা গ্রামকে ভালোবাসি, এখানেও তাই। তবে একটু ভিন্নতা অন্যখানে। আমাদের দেশে তুলনামূলক গরিব মানুষেরা গ্রামে থাকে। এখানে উল্টো। ধনী মানুষেরা গ্রামে থাকে। বাংলাদেশে কৃষক মানেই তুলনামূলক গরিব। আর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য বা ইউরোপে কৃষক মানেই ধনী। 

ম্যানচেস্টার এয়ারপোর্টে নেমেছি আগের রাতে। এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেনে করে গিয়েছিলাম ম্যানচেস্টার পিকাডোলি রেলস্টেশনে। সেখান থেকে আরেক ট্রেনে নটিংহ্যাম। অনেক রাতে পৌঁছেছিলাম বাসায়। উঠেছি ফরেস্ট ফিল্ডের  হাইসন গ্রিনে। দীর্ঘ জার্নি, দিন রাতের ব্যবধান, জেট লেগ; সব মিলিয়ে অনেক রেস্ট নিতে হয়েছিল। 

লাঞ্চের পর দেখা করতে  এলেন মহসিন ভাই। খুব মাই ডিয়ার মানুষ। এসেই কোলাকুলি। অনেক দিন পর দেখা। তিনি জানেন আমি ঘুরতে খুব ভালোবাসি। গ্রাম, নদী, বনাঞ্চল, পাহাড় এসব বেজায় পছন্দ আমার। আগের বার বেশকিছু জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। জানতে চাইলেন, কোথায় যাবো। বললাম, গ্রামের দিকে, কোনো নদীর ধারে চলেন।  

নটিংহ্যাম শহর ছাড়িয়ে পূর্বদিকে চললো গাড়ি। শহরের পরই দেখছিলাম একের পর এক ফার্ম হাউজ। এখানে ফার্ম হাউজ মানেই ফসলের মাঠ। সঙ্গে কৃষকের বাড়ি। বাড়িতে কয়েকটি ঘর। কোনো কাঁচাঘর নেই। সবই পাকা ভবন। একতলা-দোতলা। বাড়িতে কয়েকটি গাড়ি আছে। আছে ট্রাক্টরসহ যন্ত্রচালিত কৃষি যন্ত্রপাতি। শ্রমিকদের থাকার জায়গা। ফসল নেওয়ার গাড়ি। চলাচলের জন্য প্রাইভেট কার; সবাই আছে। সঙ্গে গরু বা ভেড়ার জন্য বেড়া দেওয়া বড় তৃণভূমি। ফসল ফলানোর জন্য বড় বড় ক্ষেত। ছোট বাগান, বাংলোঘর। 


এখানে শীতকালে তেমন কোনো ফসল হয় না। সব ফসল হয় সামার বা গ্রীষ্মকালে। এখানে গ্রীষ্মকালও অনেক ঠাণ্ডা। চোখে পড়ছিল বেশিরভাগ গমক্ষেত। মাঝে মাঝে সরিষাক্ষেত। ছিল আরও কিছু ফসলের মাঠ। 

মূল রাস্তা থেকে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকলো গাড়ি। ওটা একটা গ্রাম। কিছুদূর পর পর একটা করে বাড়ি। বাড়িগুলো খুব নিরিবিলি। ভেতরে মানুষ থাকে কি নেই, বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না। ধনী ও সৌখিন মানুষেরা থাকেন এদিকটায়, গ্রামের দিকে। বিশেষ করে যারা প্রকৃতি ভালোবাসেন, অবসর জীবন-যাপন করেন; তারাই থাকেন। গ্রাম বলে বাড়ির দাম যে কম, তা-ও নয়। 

পার্কিং এরিয়াতে গাড়ি রেখে হাঁটতে শুরু করলাম। এখানে জায়গা খালি থাকলেও সব জায়গায় গাড়ি রাখা যায় না। পাশে একটা ঘোড়ার আস্তাবল চোখে পড়লো। সঙ্গে একটি সুন্দর ক্যাসেল টাইপের বাড়ি। ক্যাসেল সাধারণত দুর্গের মতো বাড়ি। যেগুলো খুব মজবুত হয়। পাথরের তৈরি। পাশেই শান্ত লেক। লেকের উভয় পাড়ে অসংখ্য গাছগাছালি। বসার বেঞ্চ, মাছ ধরার জায়গা। খুব নিরিবিলি। দেখেই মন জুড়িয়ে যায়। 

কিছুদূর সামনে যেতেই দেখলাম একটা নৌকার গলুইয়ে চেয়ার পেতে বসে ছিলেন একটা লোক। ছোট কোষা টাইপের নৌকা। থাকা-খাওয়া-বিশ্রাম-ঘুমানো; সব ওই নৌকার মধ্যেই। অনেকটা আমাদের দেশের বেদে জীবনের মতো। যদিও তারা সৌখিন বেদে। বিপদে পড়ে নয়, শখ করে এসব করে। কেউ কেউ নাকি বাড়ি বিক্রি করে নৌকা কিনে সেখানেই জীবনযাপন করে!

কিছুটা সামনে এগোতেই চোখে পড়লো নদী। নদীর নাম ট্রেন্ট। স্থানীয়রা বলেন ট্রেন্ট রিভার। জায়গাটার নাম গুনথ্রুপ। একটা স্লুইচগেট আছে ওখানে। জায়গাটা দেখেই কমন পড়ে গেলো। করোনা মহামারির আগেও একবার ওখানে গিয়েছিলাম। ছবি তুলেছিলাম। তখন সঙ্গে ছিল সাংবাদিক অহিদুজ্জামান ও তার ছেলে। মহসীন ভাই-ই নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি জায়গাটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।

নদীর ধারে একটা রেস্টুরেন্ট এরিয়া। তার বাইরে বেঞ্চে বসেছিলেন বুড়া-বুড়ি। একজন আরেকজনকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন। মনোরম ভিউ পয়েন্ট হলেও লোকজন খুব একটা ছিল না। আগেরবার দেখেছিলাম, এক যুবতী ও যুবক একটা ইয়ট নিয়ে নদীতে নেমেছিলেন। তীব্র স্রোতের বিপরীতে তারা বড় নৌকাটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। স্লুচগেট খুলে দেওয়া হয়েছিল। পরে অনেক কষ্টে তাদের প্রেমের নৌকা ভিড়েছিল তীরে। 

গুনথ্রুপে নদীটা খুব একটা প্রশস্ত নয়। তবে স্রোত ছিল বেশ। স্থানীয়দের কাছে এটি একটি চমৎকার জায়গা। নদীর পূর্ব পাড়ে বিশাল বনভূমি। ভেবেছিলাম ওটা সরকারি বনাঞ্চল। অথবা ন্যাশনাল পার্ক এমন কিছু হবে। মহসিন ভাই জানালেন, ওটা প্রাইভেট বন। কোনো এক লোকের মালিকানাধীন। নদীর পাড়ের ওই ঘন বনটাই আমাকে বেশি টানছিল। আগেরবার মনে হয়েছিল ওখানেই থেকে যাই। বৃন্দাবনের মতোই প্রেমের বন আমার কাছে সেটা। এবারো দেখলাম সেই মন কাড়া বন। 

বনের ধারে লাল মাটির পাড়। কিছু গাছ নুইয়ে ছিল, ছুঁয়ে ছিল নদীর জল। স্রোতে বলকিয়ে উঠছিল সফেদ ফেনিল উতলা জলরাশি। ভেসে যাচ্ছিল গাছের পাতা। নিচে স্বচ্ছ নুড়ি পাথর। অজানা ভাটিতে বয়ে গিয়েছিল অচেনা স্রোতরাশি। 

গুনথ্রুপ পড়েছে নিউওয়ার্ক ও শেরওড ডিস্ট্রিকের মাঝখানে। এখানে নিউওয়ার্ক এবং নটিংহ্যাম এর মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ট্রেন্ট নদীর ওপর একটি ব্রিজ আছে।  

২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী গুনথ্রুপ ভিলেজে মানুষ ছিল ৭৫২ জন। ২০১৭ সালে ছিল ৫৬৬। ২০১৯-এ এসে লোকসংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫৯ জনে। তার মানে ৭/৮ বছরে গ্রামের লোকসংখ্যা কমে গেছে। কমার কারণ কী? গ্রাম থেকে শহরের দিকে মানুষ বেশি ভিড়ছে কাজের সন্ধানে। এছাড়া দৃশ্যমান আর কোনো কারণ নেই। তবে ,বলা চলে এটি এখন বুড়োদের গ্রাম। বুড়োরা মারা গেলে তাদের জায়গায় নতুন করে হয়তো কেউ আসেনি। কারণ আছে আরেকটা। স্লুইচগেট সংলগ্ন একটি রেস্টুরেন্ট ও ছোট মার্কেট ছিল। সেটিও এখন নেই। ফলে এখানে মানুষ বেড়াতে আসেন, থাকতে আসেন না। 

ট্রেন্ট নদীর পাড়ে এই জায়গাটা চমৎকার রেস্ট লোকেশন। অনেকেই প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন। বাঁধানো পাড়ের সবুজে মোড়া জায়গাটায় যাওয়ার জন্য একটা ছোট কাঠের গেট। আমরা যাচ্ছিলাম দেখে এক ইংরেজ যুবক গেট খুলে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা ভেতরে প্রবেশের পর গেট ছেড়ে দিলেন। না, তিনি গেটকিপার নন। এখানকার মানুষগুলোই প্রকৃত মানুষ। তারা মানুষকে হেল্প করার জন্য মুখিয়ে থাকেন। আর আমাদের দেশে! 

নদীর পাড়ে দেখলাম হলুদ ছাওয়া ঘাসময় জায়গা। বড় বড় ঘাস। খুব নরম, কোমল সে ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে ভীষণ মজা। তার সঙ্গে ফুটে আছে ঝরা সরিষার ফুল। হলুদের মাঝে বসে ছবি তুললাম, দৌড়ালাম। ওখানে গেলে যে কারো মন চঞ্চল হয়ে উঠবে। 

সাইকেল নিয়ে কেউ কেউ দূরে চলে যাচ্ছিল ট্রেন্টের পাড় ধরে। কেউ হেঁটে নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছিলেন। শিশুসহ পরিবারের লোকজন নিয়ে গিয়েছিলেন কেউ কেউ। কারও সঙ্গে ছিল পছন্দের মানুষটি। কেউ গিয়েছিলেন রোদ পোহাতে। ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার কথা অনেকেই জানেন। মেঘলা-আর বৃষ্টি থাকে সব সময়। গ্রীষ্মে রোদ উঠলে ঈদের আনন্দে নেচে ওঠেন তারা। সেনি বিকেলটা ছিল আলো ঝলমল। তাই ফুরফুরে মন নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়েছিলেন অনেকেই। 

ফেরার পথে দেখলাম নদীল একটা জায়গায় ড্যাম দেওয়া। ড্যাম হচ্ছে বাঁধ। এসব নদীতে সাধারণত রাবার ড্যাম থাকে। পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। ড্যাম অতিক্রম করে ভাটিতে পানি পড়ায় স্রোতটা সেখানে বেশি দৃশ্যমান ছিল। ড্যামের উজানে, দক্ষিণ পাশে ভরা নদী, কিন্তু স্রোতহীন-শান্ত। সেখানে নোঙ্গর করা ছিল অসংখ্য নৌকা। ওই যে জীবন নৌকা। যে নৌকায় সখের সওদাগররা থাকেন। 

মহসিন ভাই বললেন, পরিচিত এক লোক এক লাখ ৩০ হাজার পাউন্ডে তার বাড়ি বিক্রি করেছেন। একটা নৌকা কিনেছেন ৭০ হাজার পাউন্ডে। এরপর থেকে নৌকাতেই থাকেন। খুব মজায় আছেন। জীবন উপভোগ করছেন।

 চলবে...


উপদেষ্টা সম্পাদক: সামছুল আলম
সম্পাদক:  উদয় হাকিম
প্রকাশক: লোকমান হোসেন আকাশ



কার্যালয়: বসতি অ্যাসোসিয়েটস (সি-৩), প্লট- ০৬,
ব্লক- এস ডব্লিউ (এইচ), গুলশান এভিনিউ, গুলশান-১, ঢাকা।
মোবাইল: ০১৭১৫১১৯৪৪৪,
ইমেইল: dhakabusines@gmail.com