পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এ কারণে পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগ ও টার্নওভার কমে গেছে। তাদের ধারণা, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন(বিএসইসি)-এর ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কারসাজির কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছ। এ কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, চরম অস্থিরতায় কাটছে বর্তমান পুঁজিবাজার। বিভিন্ন কোম্পানির লেনদেন কমে গেছে উল্লেখযোগ্যহারে। কমিশন পুঁজিবাজারে কখনো ফ্লোর প্রাইস প্রয়োগ করছে। কখনো উঠিয়ে নিচ্ছেঠ। কমিশনের এমন সিদ্ধান্তের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। পাশাপাশি ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও মার্চেন্ট ব্যাংকসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়ে সাইড লাইনে চলে গেছে। তারা নতুন করে বিনিয়োগে আসছে না। বাজার স্থবির হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনে পুঁজিবাজার নিয়ে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। কবে নাগাদ বাজার পরিস্থিতি ভালো হবে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তবে তারা বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে ফেরাতে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, কয়েকমাস আগে ১৬৯ কোম্পানির ওপর আরোপিত ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করে নেয় কমিশন। তবে ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলেও কমিশন কোম্পানিগুলোর দরপতনের সীমা একদিনে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ও দরবৃদ্ধির সীমা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। কমিশনের এই সিদ্ধান্ত বাজার উন্নয়নে কাজে লাগেনি। পাশাপাশি বর্তমানে আরও কিছু কোম্পানিতে ফ্লোর প্রাইস প্রয়োগ করেছে কমিশন।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইস দেওয়ার কারণে আইসিবি, ব্রোকার্স, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন বড় বড় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে সাইড লাইনে চলে গেছে। তারা ওই টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে না। নতুন করে বিনিয়োগের জন্য বাজারের বড় ধরনের পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে। এসব বিনিয়োগকারী কমিশনের দেওয়া ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেওয়ার চাপ দিতে পারে।’
কাজী আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, ‘কমিশন তো সেই ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়নি। ফলে তারাও হাত গুটিয়ে বসে আছে। এছাড়া, ডলার সংকট, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পাশাপাশি সামনে রোজা ও ঈদ রয়েছে। রয়েছে আগামীতে জাতীয় নির্বাচন। ফলে সামনে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এসব কারণে বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।’
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)-এর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম ফারুক বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও লোকাল পলিটিক্সের কারণে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তাদের পুনরায় বিনিয়োগে আগ্রহী করতে হলে ক্যাপিটাল মার্কেটে নেটিং সিস্টেম চালু করতে হবে। অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ভালোভাবে চালু করতে হবে। সিসিবিএলের কার্যক্রম চালু না হওয়ার কারণে ডেরিভেটিভ প্রডাক্টগুলো আনতে পারছি না। সিসিবিএলের কার্যক্রম দ্রুত চালু করতে হবে।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাইফুর রহমান বলেন, ‘প্রায় ২০০ কোম্পানির শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস দেওয়া আছে। এগুলোর বেশিরভাগ শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা ট্রানজেকশন করছে না। ফলে আমরা বাজারের উন্নয়নে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছি। ভালো কিছু কোম্পানি বাজারে আনার চেষ্টা করছি। কিছু নতুন প্রডাক্ট নিয়ে কাজ শুরু করছি। ফ্লোর প্রাইসের বিষয়টি রেগুলেটরের সিদ্ধান্ত। এছাড়া আগে থেকেই পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাভাব ছিলই। যার প্রভাব এখনো কাটেনি।’
সাইফুর রহমান আরও বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে পলিসি মেকারদের বলেছি, ‘বাজারে পলিসি সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। জাতীয় রাজস্ববোর্ডকেও মৌখিকভাবে জানিয়েছি, বাজারের সামগ্রিক চিত্র। ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে হলে তাদের কিভাবে সাপোর্ট দেওয়া যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে তালিকার বাইরের কোম্পানির ট্যাক্সের পার্থক্য বাড়ানোর দাবি জানিয়েছি। পাশাপাশি ডিভিডেন্ডকে ট্যাক্স ফ্রি রাখতে হবে। যেন বিনিয়োগকারীরা ডিভিডেন্ডের ওপর আগ্রহী থাকে। বন্ড মার্কেটকে সচল করতে হবে। আমাদের মার্কেটে বন্ড লিস্টেড আছে মাত্র ১০টি। এগুলোকে বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। তবেই মার্কেট ভাইব্রেন্ট হবে। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।’
বিএসইসি’র কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘মার্কেটে নানারকম গুজব তৈরি হয়েছে। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।’ তিনি বলেন, ‘মার্কেটে কিছু তথ্য সঠিকভাবে যাচ্ছে না। আমরা বারবার বলেছি এই মুহূর্তে ফ্লোর প্রাইস তুলে নিচ্ছি না। কিন্তু কেউ কেউ এটিকে আমলে নিচ্ছেন না। এটিকে গুজব বানিয়ে মার্কেটে ডাইমেনশন তৈরি করছেন। ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। কিন্তু প্রতিমুহূর্তে এটা নিয়ে রিউমার ছড়াচ্ছে একটি চক্র। যার প্রভাব বিনিয়োগকারীদের মাঝে পড়ছে। গত দুই/এক মাস ধরে অনেকে বলে আসছেন, মার্কেট থেকে ফ্লোর প্রাইস উঠে যাচ্ছে। একটি চক্র মার্কেটে গুজব ছড়িয়ে মার্কেটকে অস্থির করে তুলেছে। এসব অস্থিরতায় বাজারে বিনিয়োগ কমে গেছে।’
উল্লেখ্য, ডিএসই-সূত্রে জানা গেছে, গত মাস (জানুয়ারি) এর ২৬ তারিখে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ৫০৫ কোটি ৫৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। আর চলতি মাসের ২৭ তারিখে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২৬১ কোটি ৭৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা। প্রায় এক মাসের ব্যবধানে লেনদেন কমেছে ২৪৩ কোটি ৮০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ ৪৮ শতাংশ।
ঢাকা বিজনেস/এনই/