আজফর আলী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আমারে যাইতে দে মামাই। কতদিন তোর মায়ের কবরটা জিয়ারত করি না। বাড়িটাতে কেউ নাই। আমি গেলে আলো জ্বলবে। এবার কাকলী ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। সে থেমে যাওয়া কণ্ঠে সুধায়, আমিও যাব মা’কে দেখতে। এখন আমার বাসায় চল। বিষুদবার মেরাজের ছুটি। শুক্র-শনি সপ্তাহিক বন্ধ। তুমি আর আমি গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসব। তোমার জামাইও সাথে যাবে। এখন বাসায় চলো। আজফর আলীকে টেনে নিজের গাড়িতে তুলে কাকলী।
যাওয়ার আগে নেমে আসে। নাফিসের মুখোমুখি দাঁড়ায়।
ভাইয়া আমিতো মা-বাবা কোনোটাই পাই নাই। তাদের চেহারা কেমন ছিল জানি না। একবছর বয়সে এতিম হইছিলাম। তিন বছর বয়সে মা হারা। তারপর মামা হইছিল বাপ আর মামী মা। সেই মামীও আজ নাই। মামাই কয়দিন আছে কে জানে। বাকি জীবনটা আমার কাছে থাকুক। মামাইকে আমার কাছে রাখি। তুমি তাকে আমার কাছে থাকতে বল। তোমারতো স্বজনের অভাব নাই। তার থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমার যায় আসে। আমার এই দুনিয়ায় কেউ নাই। আমি বড় এতিম। আমার দাদা বাড়ি কোথায় আমি চোখে দেখি নাই। নানা বাড়ি বলে আর কিছু নাই। খালি মামা আছে। সে চলে গেলে আমার আর কিচ্ছু থাকে না। সে যতদিন হায়াতে আছে আমার কাছে থাকুক।
নাফিস চুপ করে থাকে। তার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।
চলে যেতে গিয়ে কাকলী আবার ফিরে দাঁড়ায়।
কেমনে তুমি এই মানুষটারে একা গফরগাঁও পাঠাও। মামাই বয়সে অন্ধ হইছে। আর তুমি হইছ মোহে। এই মানুষটা গাঁয়ে গিয়া একা কেমনে থাকব একটা বারও চিন্তা করলা না। আমারে একটা ফোন দেয়ার সময়ও তোমার হয় না। একটা বাচ্চা মেয়ে ফোন দিয়ে ফুপ্পী দাদুনিরে তোমার কাছে নিয়ে রাখ বলে হাউমাউ করে কান্দে। আর তুমি কেমনে নির্বিকার থাক। কেমনে পার তুমি। কেমনে।
নাফিস এবারও বিনা বাক্যব্যয়ে কাকলীকে বলতে দেয়। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কাকলী কাপরের আচলে চোখ মুছতে মুছতে আপন মনে বিরবির করে যায়।
কাকলী মামাকে নিয়ে চলে যাবে বলে গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। আজফর আলী ছেলেকে ইশারায় কাছে ডাকে। হাতটা টেনে নিয়ে চুমু খায়। নাফিস তখনো চুপ করে থাকে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। এক রাস্তা পেরিয়ে জানযট ঠেলে আরেকটা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। আজফর আলীর মনে বড় দুঃখ। সে দুঃখে প্রায়ই সে কান্দে। এখনো গাড়িতে বসে বোবা কান্না কাঁদছে। তবে সে কান্না অনেক সুখে দুঃখী হওয়ার কান্না। কখনো কখনো সীমাহীন সুখের উপলক্ষ মানুষকে ভীষণ দুঃখী করে তুলে। আজফর আলীর এই মুহূর্তে সেটাই হচ্ছে বোধহয়।