পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় চলচলকারী গণপরিবহনগুলোতে বকশিশ হিসেবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত যার পরিমাণ ৮৩২ কোটি ৩০ লাখ টাকায় দাঁড়াবে। বুধবার (২৬ মার্চ) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় পর্যবেক্ষণ উপকমিটির সদস্যরা গত ২০ মার্চ থেকে ঢাকা মহানগরীতে দেশের সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশ পথে ঈদযাত্রা পরিস্থিতি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রীসেবার সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে এমন তথ্য তুলে ধরেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এবারের ঈদে ঢাকা থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ গ্রামের বাড়ি যাবে। এছাড়া ঈদবাজারসহ নানান প্রয়োজনে বিভিন্ন গণপরিবহনে বাড়তি ট্রিপ সম্পন্ন হবে। এসব যাত্রীদের নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন যাতায়াত নিশ্চিত করার পাশাপাশি অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী তৎপরতার মধ্যেও এবারে ঈদযাত্রায় কেবল ঢাকা ছাড়তেই ৮৩২ কোটি ৩০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে।
সংগঠনটির পর্যবেক্ষণে অনুযায়ী, সরকার বাস-লঞ্চ ও বিভিন্ন গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণে চালক, সহকারীর বেতন-ভাতা ও দুই ঈদের বোনাস প্রতিদিনের আদায়কৃত ভাড়ায় ধার্য্য থাকলেও দেশের কোনো পরিবহনে তা কার্যকর নেই। ফলে এবারের ঈদে ৯৮ শতাংশ গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এবারের ঈদে সবচেয়ে বেশি যাত্রী নৌপথে পরিবহন হবে। ঢাকার সদরঘাট ও নারায়ণগঞ্জ নদী-বন্দরসহ বিভিন্ন ঘাট দিয়ে ২০০টি ছোট-বড় নৌযানে প্রায় ৪০ লাখ যাত্রী দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাবে। যাত্রীপ্রতি গড়ে ৫০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত শ্রেণিভেদে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। গড়ে যাত্রী প্রতি ২০০ টাকা হারে বাড়তি ভাড়া আদায় হলে ঈদের আগে এসব যাত্রীদের কাছ থেকে ৮০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ঈদে কেনাকাটা, বিভিন্ন টার্মিনালে যাতায়াতের পাশাপাশি দৈনন্দিন নানা কাজে এসব অটোরিকশা ব্যবহার করতে গিয়ে প্রত্যেক যাত্রীকে গড়ে প্রতি ট্রিপে ২০০ টাকা হারে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। ঈদে আগে রাজধানীতে চলাচলকারী ২০ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশায় প্রায় ৩০ লাখ ট্রিপ যাত্রীকে ৬০ কোটি টাকার বেশি বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, প্যাডেলচালিত রিকশা ঈদ বকশিসের নামে যাত্রীপ্রতি গড়ে ২০ টাকা হারে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি মনে করে, রাজধানীতে চলাচলকারী প্রায় ৮ লাখ ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, প্যাডেলচালিত রিকশায় ৮ কোটি ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত হতে পারে। এই যানবাহনে যাত্রীদের ১৬০ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে।
লেগুনা, দুরন্ত, দিগন্ত নানা নামে পরিচিত রাজধানীতে চলাচলকারী ৭ হাজার হিউম্যান হলারে ঈদের আগে প্রায় ৮০ লাখ ট্রিপ যাত্রীকে ঈদ বকশিসের নামে গড়ে প্রায় ২০ টাকা ভাড়া বাড়তি দিতে হবে। সেই হিসেবে ঢাকার হিউম্যান হলারে কেবল ১৬ কোটি টাকার বেশি বাড়তি ভাড়া আদায় হবে।
প্রাইভেটকার, জিপ ও মাইক্রোবাস ২০ হাজার, যেখানে ৬০ হাজার ট্রিপে গড়ে সাড়ে ৩ হাজার টাকা হারে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে। সেই হিসেবে এই পরিবহন ব্যবহারকারী যাত্রীদের ২১ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে।
এবারের ঈদে ঢাকা থেকে দুরপাল্লার রুটে বাস-মিনিবাসে ৩০ লাখ ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াতে যাত্রীপ্রতি গড়ে ৩০০ টাকা হারে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। সেই হিসেবে দুরপাল্লার রুটে বাস-মিনিবাসের যাত্রীদের ৯০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে।
প্রতিবছর ঈদে ঢাকা মহানগরীতে চলাচলকারি সিটি বাস সার্ভিসগুলো ঈদের ২ দিন আগে থেকে যেকোন গন্তব্যে গেলে ঈদ বকশিসের নামে ৫০ টাকা হারে যাত্রীর মাথাপিছু ভাড়া আদায় করে থাকে। এবারও ঈদের আগের ২ দিনে ঢাকার ৩ হাজার সিটি বাসে ৪০ লাখ ট্রিপ যাত্রীর কাছ থেকে গড়ে মাথাপিছু ৩০ টাকা হারে বাড়তি নিলে এইখাতে ১২ কোটি টাকা যাত্রীদের বাড়তি গুনতে হবে।
গণপরিবহন সংকট, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, সঠিক সময়ে টিকিট না পাওয়া, যানজটসহ নানান ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে এবারের ঈদে প্রায় ২৫ লাখ যাত্রী মোটরসাইকেলে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। তাদের ৩০ শতাংশ নিজেদের বাইক ব্যবহার করছে। কেবলমাত্র ঢাকা মহানগরীর ৫ লাখ রাইডশেয়ারিং মোটরসাইকেলে যাত্রী প্রতি গড়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ১০০ টাকার বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। এতে ২ কোটি ৫০ লাখ ট্রিপ যাত্রীর কাছে ২৫০ কোটি বাড়তি ভাড়া আদায় করছে।
প্রতিবছর ঈদে ট্রেনের ছাদে যাত্রী পরিবহন ঠেকাতে নানান ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও বিপুল সংখ্যক নিম্নআয়ের লোকজন কম খরচে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে যাত্রী হিসেবে ভ্রমণ করে থাকে। এবারের ঈদে ঢাকা থেকে ৮০ হাজার যাত্রী ট্রেনের ছাদে করে বাড়ি যাবে। তাদের প্রত্যেককে গড়ে কমপক্ষে ১০০ টাকা হারে ৮০ লাখ টাকা রেলে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ঘুস দিতে হবে। খাবার গাড়ি, ইঞ্জিন, দুই বগির মাঝে, কোচের ভেতরে বিনা টিকিটে যাতায়াত করবে আরো প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার যাত্রী। ট্রেনে কর্মরত টিটিই, গার্ড, সরকারি-বেসরকারি স্টুয়ার্ড, বেসরকারি ক্যান্টিন অপারেটরের লোকজন, ট্রেনে দ্বায়িত্বরত জিআরপি, এনআরবি ও স্টেশনে দায়িত্বরত টিকিট চেকারদের যাত্রী প্রতি গড়ে ৩০০ টাকা হারে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঘুস দিতে হবে।
আকাশপথে সরকারি-বেসরকারি উড়োজাহাজে ঈদের ১০দিন আগে থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের মহোৎসব চলছে। কোনো কোনো পথে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় হচ্ছে। এই ঈদে কমপক্ষে ১ লাখ যাত্রী অভ্যন্তরীণ রুটে আকাশপথ ব্যবহারে যাত্রী প্রতি গড়ে সাড়ে ৩ হাজার টাকা বাড়তি ভাড়া নিলে ৩৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে।
সংগঠনটি বলছে, সদরঘাট নদীবন্দরসহ বিভিন্ন লঞ্চ ও খেয়াঘাটে নৌ-পথে যাতায়াত ও খেয়া পারাপারের যাত্রী সাধারণের কাছ থেকে ঈদ উপলক্ষে ৫ টাকার মাসুল ঘাট ইজারাদারের লোকজন ১০ থেকে ২০ টাকা হারে আদায় করে থাকে। এসময়ে পণ্য নিয়ে খেয়া পারাপার বা লঞ্চে আরোহণে ৫০০ থেকে ১০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত কুলি মজুরি বাবদ দাবি করা হয়। খেয়া পারাপারে ঈদবাজারের প্যাকেট প্রতি মাসুল দাবি করা হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এবারের ঈদে সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের আশেপাশে খেয়া পারাপারে ১০ কোটি ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত হবে। এসব যাত্রীর মাথাপিছু ১০ টাকা হারে বাড়তি হিসেবে ১০০ কোটি টাকা বাড়তি ঘাট মাসুল আদায় করে লুটপাট করে ইচ্ছেমতো যাত্রী হয়রানি করছে, বেসরকারি ইজারাদার, বিআইডব্লিউটিএর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এসব লুটপাটের পৃষ্ঠপোষকতা করছে।