ধর্ষণের মহামারী বন্ধ হবে কবে


সাজেদুর আবেদীন শান্ত , : 10-03-2025

ধর্ষণের মহামারী বন্ধ হবে কবে

৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বব্যাপী নারীর অধিকার, নিরাপত্তা ও সমতার কথা যখন আলোচিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা আমাদের সমাজের ভয়াবহ বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। 

মাত্র একদিনের ব্যবধানে নয়টি ধর্ষণের ঘটনার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঠাকুরগাঁওয়ে শ্রেণিকক্ষেই পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ, আটক শিক্ষক। অন্যদিকে জনকণ্ঠের শিরোনাম, সমুদ্রসৈকতে দিনদুপুরে গণধর্ষণের শিকার কলেজছাত্রী। 

বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফরিদপুরে ধর্ষণের শিকার সাড়ে চার বছরের শিশু। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের অনলাইন পোর্টালে খবর এসেছে, কুমিল্লায় বাকপ্রতিবন্ধী তরুণী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, বৃদ্ধ গ্রেপ্তার। ঢাকা ট্রিবিউন শিরোনাম করেছে খাবারের লোভ দেখিয়ে দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, বৃদ্ধ গ্রেপ্তার। বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর শিরোনাম করেছে লক্ষ্মীপুরে ধর্ষণের পর সালিশ, ‘হুমকির মুখে’ কিশোরীর আত্মহত্যা। বার্তা টুয়েন্টিফোরের শিরোনাম নরসিংদীতে গর্ভবতী নারীকে আটকে রেখে গণধর্ষণ, আজকের পত্রিকায় বলা হয়েছে শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, সালিসে দেড় লাখ টাকা জরিমানা, বাকি ৫৮ হাজার এবং কালের কন্ঠের শিরোনাম শ্রীপুরে ৮ বছরের শিশুকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ, ভিডিও ধারণ—এই নয়টি ঘটনা সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর নিরাপত্তাহীনতার নির্মম চিত্র তুলে ধরেছে। 

এদিকে মাগুরার ধর্ষণের শিকার সেই ৮ বছরের শিশুকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) নেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল সূত্র জানায়, শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। ভেন্টিলেটর যন্ত্রের সাহায্যে তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে। পাশবিক নির্যাতনের কারণে শিশুটির যৌনাঙ্গে ক্ষত রয়েছে। তার গলার আঘাত গুরুতর।  

এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে—আমরা কি শুধুই ধর্ষণের সংখ্যা বাড়তে দেখব, নাকি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেব? ধর্ষণ প্রতিরোধে কঠোর আইন থাকলেও অপরাধীরা কীভাবে বারবার পার পেয়ে যায়? সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কি ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের দুর্বল করে দিচ্ছে? 

বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, কিন্তু কার্যকর বিচারপ্রক্রিয়ার অভাবে অপরাধীরা প্রায়শই শাস্তি এড়িয়ে যায়। অধিকাংশ মামলার তদন্ত দীর্ঘসূত্রিতা ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের কারণে বছরকে বছর ঝুলে থাকে। ধর্ষণের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি প্রধান বিষয় উঠে আসে। তা হলো; এক. বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা: অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের মামলা শেষ হতে ৫-১০ বছর লেগে যায়। ফলে ভুক্তভোগী পরিবার ন্যায়বিচারের আশা ছেড়ে দেয়। দুই. অপরাধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব। ধর্ষণ মামলায় প্রভাবশালী অপরাধীরা বেশিরভাগ সময় পার পেয়ে যায়। তিন. ভুক্তভোগীকে হয়রানি করা। মামলা করতে গেলে ভুক্তভোগীকে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়, যা অনেক নারীকে মামলা করা থেকে বিরত রাখে। 

এই অবস্থায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রতিটি ধর্ষণ মামলার নিষ্পত্তি ছয় মাসের মধ্যে করা জরুরি। সাক্ষীদের নিরাপত্তা, ডিজিটাল প্রমাণ সংরক্ষণ ও দ্রুত ফরেনসিক পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে অপরাধীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে। ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা ও সহায়তার জন্য আইনি সহায়তা কেন্দ্র আরও প্রসারিত করা প্রয়োজন। 

তবে আইন যত কঠোরই হোক, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে ধর্ষণ বন্ধ হবে না। আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনায় এখনো ভুক্তভোগীকেই দায়ী করা হয়। পোশাক, চলাফেরা, সময় বা অবস্থানকে অপরাধের কারণ হিসেবে দেখানোর প্রবণতা অপরাধীদের জন্য এক ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা তৈরি করে। সমস্যাটি গভীরে যাওয়ার জন্য আমাদের বুঝতে হবে: শৈশব থেকেই ছেলে ও মেয়েদের সমান মর্যাদার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি? নারীদের প্রতি সম্মান ও সম্মতির (consent) গুরুত্ব পরিবারে আলোচনা করা হয় কি? স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের লিঙ্গসমতা ও নারী অধিকার বিষয়ে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। 

ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়তে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা, স্কুল-কলেজে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা এবং গণমাধ্যমে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যেমন টিভি, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের পরিবর্তে, নারীকে মর্যাদার আসনে স্থান দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। 

শুধু আইন ও সামাজিক সচেতনতা বাড়ালেই ধর্ষণ বন্ধ হবে না, নিরাপত্তার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি। সিসিটিভি ক্যামেরা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, অফিস ও গণপরিবহনে নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ চালু করা প্রয়োজন। ধর্ষণ বা হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়ার জন্য একটি কার্যকর হেল্পলাইন চালু করা দরকার। এছাড়া যুবসমাজের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। অনেক ধর্ষণের ঘটনায় মাদকের সংযোগ থাকে। বেকারত্ব ও মাদকাসক্তি কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে হবে। মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে। 

এছাড়া ধর্ষণ প্রতিরোধে পুরুষদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। স্কুল-কলেজে সঠিক যৌন শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে তরুণরা নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং যৌন বিষয়গুলো সম্পর্কে স্বাস্থ্যসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি পায়। মনে রাখতে হবে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল নারীদের কাজ নয়—এটি সমগ্র সমাজের দায়িত্ব। এখনই সময় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করা, আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ—এই চারটি স্তম্ভের ওপর নির্ভর করছে নারীদের নিরাপত্তা। 

আমরা কি এমন সমাজ চাই, যেখানে প্রতিদিন আমাদের বোন, মেয়ে, শিশু ও তরুণীদের ধর্ষণের শিকার হতে হয়? নাকি আমরা সবাই মিলে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলব, যেখানে নারীরা নিরাপদে বাঁচতে পারবে? এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়! 

লেখক: কবি ও সাংবাদিক


উপদেষ্টা সম্পাদক: সামছুল আলম
সম্পাদক:  উদয় হাকিম
প্রকাশক: লোকমান হোসেন আকাশ



কার্যালয়: বসতি অ্যারিস্টোক্র্যাটস (লেভেল-৩), প্লট- ০৬,
ব্লক- এস ডব্লিউ (এইচ), গুলশান এভিনিউ, গুলশান-১, ঢাকা।
মোবাইল: ০১৩২৯৬৮১৬২৫,
ইমেইল: dhakabusines@gmail.com