বিশ্ববাজারে ফের কমলো জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের দুর্বল চাহিদা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার কমার গতিতে অনিশ্চয়তার কারণে বাজারে আরও দাম কমেছে জ্বালানি তেলের। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) জ্বালানি তেলের দাম ২ শতাংশেরও বেশি কমেছে। এই নিয়ে চলতি বছরে জ্বালানি তেলের দাম চতুর্থবারের মতো কমেছে। শুধু তাই নয়, ২০২১ সালের পরে এই বছরেই জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমেছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ১ দশমিক ৫২ ডলার বা ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ কমে ৭১ দশমিক শূন্য ৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে, ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের দাম ব্যারেলপ্রতি ১ দশমিক ৬৮ ডলার বা ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ কমে ৬৭ দশমিক শূন্য ২ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম প্রায় চার শতাংশ ও ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের দাম প্রায় পাঁচ শতাংশ কমেছে।
চলতি বছরের অক্টোবরে চীনের তেল শোধনাগারগুলো এক বছর আগের তুলনায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কম প্রক্রিয়াকরণ করেছে। কারণ, প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে গেছে ও ছোট স্বাধীন শোধনাগারগুলোতে অপারেটিং হার হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া গত মাসে চীনের কারখানার উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ধীর হয়েছে। পাশাপাশি দেশটির প্রোপার্টি সেক্টরেও সমস্যা কাটেনি।
এর আগে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দামে রেকর্ড পতন হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার জেরে তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। অনেকেই তখন ধারণা করেছিলেন, তেলের দাম আবারও প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে তার উল্টো ঘটনা, আন্তর্জাতিক বাজারে তৃতীয় দফা কমে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের নিচে নেমে আসে। গত ২০২৩ সালের এপ্রিলে মাসেও অপরিশোধিত তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ছিল ৯০ ডলার। গত ১১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে ডব্লিউটিআই ক্রুড তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৬৭ দশমিক ৬৮ ডলার। ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দামও কমেছে, যদিও তা ৭০ ডলারের নিচে নামেনি। অয়েল প্রাইস ডটকম ও রয়টার্স সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমার কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে দাম কমছে। যতই সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা থাকুক, দিন শেষে বাজারে পণ্যের দাম নির্ধারণে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে চীন। কিন্তু দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় সেখানে তেল আমদানি কমেছে। যার প্রভাব আন্তর্জাতিক তেল বাজারে পড়েছে। পাশাপাশি চাহিদা কম থাকায় তেল খুব একটা মজুত করছে না চীন। সেসময় বিশেষজ্ঞরা জানান, তেলের দাম কমার এটাই মূল কারণ।
উল্লেখ্য, করোনা মহামারির সময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের চাহিদা শূন্যের কোটায় নেমে আসায় তখন অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ২০ ডলারে নেমে এসেছিল। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। একই বছরের অক্টোবরে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৮০ ডলারে নেমে আসে।
তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেকের আশঙ্কা, ২০২৪-২৫ সালে তেলের চাহিদা আরও কমতে পারে। ওপেকের তথ্য বলছে, বর্তমানে দৈনিক চাহিদা ১৭ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল হলেও তা কমে ১৭ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেলে নেমে আসতে পারে।
অ্যাঙ্গোলা, আলজেরিয়া, ইরাক, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, নাইজেরিয়া, ভেনেজুয়েলা, লিবিয়া, সৌদি আরব, গ্যাবন, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি- এই ১২টি দেশ নিয়ে গঠিত জোট ওপেকের ওপর মূলত নির্ভর করে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কতটা বাড়বে বা কমবে।
বিশ্বে তেলের চাহিদা কমলেই অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ কমিয়ে দেয় ওপেক। এদিকে গত এক বছরের অধিক সময় ধরে সংস্থাটি তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ হ্রাস করেও বাজারে দাম খুব একটা বাড়াতে পারেনি। তবে ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো আগামী বছর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উত্তোলন বাড়াতে পারে বলে জানা গেছে।
এশিয়া-প্যাসিফিক পেট্রোলিয়াম কনফারেন্সে (এপিপিইসি) এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল কমোডিটি ইনসাইটসের গবেষণা বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জিম বুরখার্ড এ কথা বলেছেন।
ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো চলতি বছরের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেই অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উত্তোলন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তেলের দাম ৭০ ডলারের নিচে নেমে যাওয়ায় তারা উত্তোলন বৃদ্ধির সময়সীমা দুই মাস পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওপেক প্লাস জানায়, প্রয়োজনে তারা উত্তোলন কমানো বা অন্য যেকোনো সিদ্ধান্তও নিতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাজারে গত ২২ এপ্রিল (সোমবার) অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১ শতাংশেরও বেশি নেমে আসে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, সোমবার অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার ব্রেন্ট ক্রুডের দাম আগের দিনের তুলনায় শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ বা ২৯ সেন্ট কমেছে। এদিন প্রতি ব্যারেল ৮৭ ডলারে কেনাবেচা হয়।
অপরদিকে ইউএস ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম ২৯ সেন্ট বা শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ কমেছে। বাজারে এই তেল প্রতি ব্যারেল ৮২ ডলার ৮৫ সেন্টে কেনাবেচা হয়।
মার্কিন সিনেট সেসময় ইরানের তেল রপ্তানি কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞার দেওয়ার চিন্তা করে। এতে ইরানি তেল পরিচালনাকারী জাহাজ, বন্দর এবং শোধনাগারগুলোকে সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে তেলের দাম আরও কমে যেতো। সেসময় বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইরান ইসরায়েল উত্তেজনা না থামলে ইরানের তেল পানির দরে বিক্রির ব্যবস্থা করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বিখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইজি মার্কেটের বিশ্লেষক ইয়েপ জুন তখন বলেছিলেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিক্রিয়া কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় ব্রেন্ট ক্রুডের দাম কমেছে। তিনি উল্লেখ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মজুদ বর্তমানে বিক্রির ওপর চাপ বাড়িয়েছে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের শুরুতে ইউক্রেন ও ইসরাইলের জন্য বড় অঙ্কের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ পাস করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইরানের জ্বালানি তেল উৎপাদনের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরও প্রসারিত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এমনটা হলে ইরানের জ্বালানি তেল উত্তোলন বাধাগ্রস্ত হবে। যার নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক তেলের বাজারেও পড়তে পারে। সূত্র: বিবিসি-রয়টার্স