আজফর আলী পাজামা-পাঞ্জাবি পড়ে, নাতনীর হাত ধরে ছাদে যায়। তখন গোধূলী। সন্ধ্যা আসবে আসবে করছে। নাতনী আবল-তাবল বকে যায় আর আজফর আলী নাতনীর মাথায় বিলি কাটে। গত কয়েকদিন ধরে তার শরীরটা খারাপ। বাসায় কী হচ্ছে কোনো খবর নেই। বাম চোখে দেখেন না বহুদিন। ডান চোখটাও ঝাপসা ঝাপসা লাগে। ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। ছেলেকে বলার সাহস হয় না। কত টাকা খরচ হয় কে জানে। ছেলের বউ এ নিয়ে ছেলের সঙ্গে রাগারাগি করবে।
ছেলেটা হয়েছে কিছুটা হাবাগুবা প্রকৃতির। সে না বাবাকে খুশি করতে পারে, না পারে বউকে সামাল দিতে। তবু তারা সুখী হোক, এই প্রার্থনায় আকাশে চোখ রাখে আজফর। সুখী থাকুক দুধে-ভাতে বড় করা আদরের ধন। তিনি যেদিন থাকবেন না সেদিন যেন অস্ত পারের তারা হয়ে তাদের সুখী দেখতে পান। ভাই-বোনহীন ছেলেটা সুখে থাকুক। শৈশবে বাবার কাঁধে ঘুমিয়ে থাকার মতো নিরাপদে থাকুক।
বাসায় এত বড় প্রোগ্রাম। অথচ সে জানে না ভেবে মন খারাপ হয়। কিভাবে কিভাবে যে একজন বাবা নিজের ছেলের সংসারে স্রেফ অতিথি হয়ে যায়! একটা জীবনের কয়টা রূপ দেখে বেঁচে থাকে মানুষ! আগে ছেলে এটা সেটা বলতো। গল্প করতো। আজকাল কিছু বলেও না। সামনে এলে চুপ করে থাকে। বউয়ের সঙ্গে তিন বেলা খাবারের বাইরে কোনো কথা হয় না। আজফর আলী নাফিসের শৈশবের চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করে। খুব চুপচাপ আর গম্ভীর প্রকৃতির ছিল নাফিস। স্কুলে যাওয়া আসার বাইরে কারও সঙ্গে খুব একটা মিশতো না। এখনো মিশে না। কথাও বলতো গুনে গুনে।
সারাক্ষণ বাবার কাঁধে উঠে থাকতে চাইতো। কাকলীর সাথে মিল রেখে বাবাই বাবাই বলে ডাকত। আজফর আলীর দু’চোখ যেন সন্ধ্যার আঁধারে ঢেকে যায়। সে চোখে কেবল শিশু নাফিসকে দেখা যায়। কালো চশমাটা সাথে নিয়ে ছাদে আসা দরকার ছিল। লোকালয়ে পুরুষ মানুষের চোখের পানি দেখার চেয়ে লজ্জ্বার আর কিছু হয় না-মনে মনে ভাবে আজফর আলী। দাদুর দিকে তাকিয়ে উলফাতও মুখ ভারী করে। পাশে হাত ধরে থাকা উলফাত অবাক হয়। এই অবেলায় হঠাৎ দাদু কাঁদছে কেন ঠাহর করতে পারে না। মাম্মি কিছু করেনি তো আবার। এবার উলফাতও মিহি কান্নার সুরে ছড়া কাটে। আজফর আলী নাতনির মাথায় হাত বোলায়। উলফাতের দাদুর মতো করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। দাদুর মনে কিসের এতো দুঃখ সে বুঝতে পারে না। দাদুকে দুঃখী দেখলে মায়ের ওপরে তার রাগ হয়। ভীষণ রাগ। বাবার ওপরে হয় অভিমান। বড়দের এত দুঃখ কেন! বুড়োদের যেন আরও বেশি। উলফাতের ভীষণ কান্না পায়।
চলবে...
বুড়ি ও পরী: পর্ব-৩ | সরোজ মেহেদী