বেড প্লান্টিংয়ে কৃষকের খরচ কমে ৭০ শতাংশ


ফেরদৌস সিদ্দিকী, রাজশাহী , : 27-01-2023

বেড প্লান্টিংয়ে কৃষকের খরচ কমে ৭০ শতাংশ

‌‘বেড প্লান্টিং’ একটি আধুনিক চাষ পদ্ধতি। সংরক্ষণশীল এ কৃষি পদ্ধতিতে ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, সরিষা, পাট, তিল, বাদাম, আলুসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে চাষে সেচ, সার ও খরচ বাঁচে কৃষকের। সুরক্ষিত থাকে প্রকৃতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো পাওয়ার টিলারের সঙ্গে ‘বেড প্লান্টার’ যন্ত্রটি যুক্ত করে সরাসরি জমি তৈরি, বীজ বপন, মই দেওয়া ও বেড তৈরির কাজ এক চাষেই হয়। স্বাভাবিক পদ্ধতির বাড়তি চাষ-মই দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এতে সার-বীজ সঠিক গভীরতায় পড়ে। ফলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বাড়ে। প্রচলিত চাষ পদ্ধতির চেয়ে বেড প্লান্টিংয়ে খরচ কমে যায় প্রায় ৭০ শতাংশ।

জানা গেছে, ২০০৩ সালে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মাত্র ৭০ জন কৃষক বেড প্লান্টিং পদ্ধতিতে গম-ভুট্টা চাষ শুরু করলেও চলতি মৌসুমে কৃষকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজারের বেশি। আর চাষ বেড়েছে ১৮ হেক্টর থেকে ৬ হাজার ৮০০ হেক্টরে। সে হিসাবে গত ২০ বছরে চাষাবাদ বেড়েছে ৩৭৮ গুণ। সাশ্রয়ী চাষ ও ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের মাঝে বেড প্লান্টিংয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বেড প্লান্টিং ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিডব্লিউএমআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও রাজশাহী অঞ্চলপ্রধান ড. মো. ইলিয়াছ হোসেন। তিনি এক হিসাবে দেখিয়েছেন, ভুট্টা চাষের জন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে এক হেক্টর জমি চাষে খরচ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। বীজ বপনে শ্রমিক খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। নালা তৈরিতে আরো শ্রমিক খরচ প্রায় ১১ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে হেক্টরে কৃষকের খরচ হয় ৩৮ হাজার টাকা। কিন্তু বেড পদ্ধতিতে মাত্র একটি চাষেই বেড তৈরি, বীজ বোনা ও চাষ হয়ে যায়। এতে সাকল্যে খরচ পড়ে ১০ হাজার টাকা। এই পদ্ধতিতে চাষে হেক্টরে ২৮ হাজার টাকা সাশ্রয় হয় কৃষকের। অর্থাৎ প্রচলিত চাষ পদ্ধতির চেয়ে বেড প্লান্টিংয়ে খরচ কমে যায় প্রায় ৭০ শতাংশ। অন্যদিকে প্রচলিত পদ্ধতিতে গম চাষে হেক্টরে খরচ ১৫ হাজার টাকা হলেও বেড প্লান্টিংয়ে খরচ হয় মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা।

ড. মো. ইলিয়াছ হোসেনের এ বিষয়ক একটি গবেষণাকর্ম ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক কৃষিবিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে কৃষকের মাঝে বেড প্লান্টিং ছড়িয়ে দিতে আরো উদ্যোমী হন এ কর্মকর্তা।

রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ৩৬ উদ্যোক্তা বিডব্লিউএমআরআই উদ্ভাবিত ১০৫টি বেড প্লান্টারে মাঠে চাষ করছেন। এদেরই একজন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ীহাট এলাকার নাজিরপুরের সফিকুল ইসলাম। ২০০৮ সাল থেকে এ প্রযুক্তির সঙ্গে আছেন তিনি। সফিকুল ইসলাম জানান, যেকোনো পাওয়ার টিলারের সঙ্গে এ যন্ত্র ব্যবহার উপযোগী। দিনে সাত বিঘা জমি তৈরি করা যায়। উন্নত বীজ মিটারের সাহায্যে বপন করা যায় সব ধরনের বীজ। বীজ থেকে বীজের দূরত্ব, গভীরতা ও পরিমাণ সুবিধামতো কম-বেশিও করা যায়। এটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ একেবারেই সহজ।

নিজেদের জমি চাষের পাশাপাশি তিনি উদ্যোগী কৃষকের জমি চাষ করে দেন। এতে প্রতি বিঘায় নেন ৬০০ টাকা। এ বছর তিনি প্রায় ২০০ বিঘা জমি চাষ করেছেন বেড প্লান্টারে।

বেড পদ্ধতিতে গোদাগাড়ীর গোগ্রাম ইউনিয়নের বাওইডাঙ্গায় ২০ বিঘা ভুট্টা চাষ করেছেন স্থানীয় কৃষি উদ্যোক্তা জাকারিয়া পারভেজ। তিনি জানান, তার গবাদিপশুর খামার রয়েছে। সেই সঙ্গে সারা দেশেই আমরা গো-খাদ্য সরবরাহ করি। গো-খাদ্য হিসেবে এ বছর ১০০ বিঘা ভুট্টা চাষ করেছি। এর মধ্যে ২০ বিঘা চাষ করেছি বেড প্লান্টারে।

বেড প্লান্টিং পদ্ধতির গবেষক ড. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, রাজশাহী অঞ্চল খরাপ্রবণ। এ অঞ্চলে সেচের পানির ঘাটতি রয়েছে। কেবল পানির অভাবে আমন মৌসুমে ৭৫ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। এ জমি চাষের আওতায় আনা সম্ভব হলে অতিরিক্ত প্রায় ৩০ টন ফসল ফলানো সম্ভব। এছাড়া এ অঞ্চলের ৩৩ হাজার হেক্টর চর আবাদযোগ্য। এসব জমি গম-ভুট্টা চাষের বিশেষ উপযোগী। সংরক্ষণশীল কৃষি প্রযুক্তিতে (বেড প্লান্টিং) চাষাবাদ করা গেলে আরো অন্তত ৮০ হাজার টন গম-ভুট্টা উৎপাদন সম্ভব।

ড. ইলিয়াছ তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, বেড প্লান্টিং প্রযুক্তিতে চাষের খরচ কমে যায় ৬০ শতাংশ। ২৫-৪০ শতাংশ সেচের পানি সাশ্রয় হয়। খেতে নাড়া বা খড় থাকায় ১০-২০ শতাংশ ইউরিয়া ও ৯ শতাংশ পটাশ সার সাশ্রয় হয়। জ্বালানি সাশ্রয় হয় প্রায় ৪০ শতাংশ। টেকসই এ প্রযুক্তিতে কার্বন নিঃসরণ কম হয় প্রায় ৪৪ শতাংশ। আবার প্রচলিত চাষে প্রতি হেক্টরে ৪৫ লিটার জ্বালানি পোড়ে। তাতে উত্পন্ন হয় ১১২ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড। কিন্তু বেড পদ্ধতিকে চাষে জ্বালানি পোড়ে ১৭ লিটার। তাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উত্পন্ন হয় ৪২ লিটার। এ পদ্ধতিতে চাষে ৭০ লিটার কম কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়।

আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১-২২ মৌসুমে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ২৩ হাজার ৭৮৭ হেক্টর জমিতে গম এবং ৫১ হাজার ৭০৭ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছিল। ওই মৌসুমে  ৯৫ হাজার ১৪৮ টন গম এবং ৪ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৯ টন ভুট্টা ঘরে তুলেছিলেন কৃষক।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, দুই দশক আগেও এ অঞ্চলে গম-ভুট্টার আবাদ ছিল প্রায় অর্ধেক। নানা সংকটে চাষিরা ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু উচ্চফলনশীল জাত, চাষের আধুনিক কৌশল ও বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক ফিরেছেন গম-ভুট্টা চাষে। একই সঙ্গে বেড প্লান্টিংয়েও আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের। 

কথা হয় কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) জলবায়ু ও প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক সিনিয়র স্পেশালিস্ট ড. মনোয়ার করিম খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে চাষের জমি। সেইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে উৎপাদনশীলতা কমছে। খাদ্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান সংকট মোকাবিলায় খাদ্য ও পুষ্টি উৎপাদন বাড়াতে বেড প্লান্টিং পদ্ধতিতে চাষের বিকল্প নেই।

তিনি আরো বলেন, সংরক্ষণশীল পদ্ধতিতে চাষের একসঙ্গে চারটি লাভ। প্রথমত, এটি কৃষকের চাষের খরচা বাঁচায়। দ্বিতীয়ত, ফসলের উৎপাদন বাড়ে। তৃতীয়ত, জীবাশ্ব জ্বালানি কম ব্যবহার হওয়ায় পরিবেশ সুরক্ষিত থাকে। চতুর্থত, জমি কম চাষ হওয়ায় মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে। 

ঢাকা বিজনেস/এইচ


উপদেষ্টা সম্পাদক: সামছুল আলম
সম্পাদক:  উদয় হাকিম
প্রকাশক: লোকমান হোসেন আকাশ



কার্যালয়: বসতি অ্যাসোসিয়েটস (সি-৩), প্লট- ০৬,
ব্লক- এস ডব্লিউ (এইচ), গুলশান এভিনিউ, গুলশান-১, ঢাকা।
মোবাইল: ০১৭১৫১১৯৪৪৪,
ইমেইল: [email protected]