প্রাচীনকালে বর্তমান গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় এক হিন্দু রাজা ছিলেন। তার নাম ছিল রাজাবিরাট। ঘাঘট নদীর তীরবর্তী এ ভূখণ্ড ছিল তার রাজ্যের অধীন। তিনি এই তৃণভূমিকে গোচারণ ক্ষেত্র ও গাভীর বাথান হিসাবে ব্যবহার করতেন। এখানে গাভীগুলো বাঁধা থাকতো বলে এ অঞ্চলের নাম হয়ে যায় গাইবান্ধা। আর এই গাইবান্ধাকে ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস। জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোও ভ্রমণপ্রেমীদের মোহিত করে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা দেখা যায়, জেলার ফুলছড়ি উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদে অবস্থিত বালাসীঘাট। এখানে একটি নৌবন্দর ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এ ঘাট দিয়ে নৌকাযোগে বিভিন্ন পণ্য আনা-নেওয়া করা হয়ে থাকে। একইসঙ্গে বিনোদনের জন্য বিভিন্ন এলাকা থাকা আসা দর্শণার্থীদের ভিড় জমে।
ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনেরপাড়া গ্রামে ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার নামের একটি ভবন অবস্থিত। মাটির নিচে নির্মিত এ ভবন উপর থেকে দেখতে অনেকটা প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের মতো। ভবনের ছাদ আর ভূপৃষ্ঠ একই লেভেলে রয়েছে। ছাদ সবুজ ঘাসে ঘেরা।
গাইবান্ধা শহরে রয়েছে পৌরপার্ক। পৌরসভার অধীনে একটি উন্মুক্ত স্থান ও সামাজিক বিনোদন কেন্দ্র রয়েছে। একটি পুকুরকে কেন্দ্র করে চারপাশে বিভিন্ন রকমের ফুল, ফল ও কাঠ গাছ দিয়ে ঘেড়া এ পুকুরের একপাশে রয়েছে শান বাধানো ঘাট। পুকুরের মাঝে রয়েছে পানির ফোয়ারা, যেখানে ছন্দের তালে তালে দোল খায় ক্ষুদ্র জলকনা।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নে জমিদার বাড়ি অবস্থিত। বাড়ির গোড়াপত্তনকারী জমিদার কৃষ্ণকান্ত রায়। বর্তমানে তার বাসগৃহ, অতিথিশালা, রাজদরবার আর হাতিশালার স্থাপনার নেই কোনো চিহ্ন। এগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। বর্তমানে দৃশ্যমান রয়েছে ৩টি পুকুর। আর বাসগৃহের স্থলে রয়েছে গুচ্ছগ্রামের রান্নার ঘর।
গাইবান্ধা সদরের নাকাইহাট সড়কের রাধাকৃঞ্চপুর নামক স্থানে ভ্রমণপিপাসু ও পর্যটকদের কথা চিন্তা করেই স্থানীয় এসকেএস ফাউন্ডেশন “এসকেএস ইন্’’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। দেশি-বিদেশি উন্নয়ন-দাতা সংস্থা, পর্যটক, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মাল্টি-ন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যাধুনিক আবাসন সেবা এবং খাবারের সু-ব্যবস্থা রয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশমণ্ডিত নান্দনিক এ ক্যাম্পাসে। প্রশিক্ষণ, কনফারেন্স, সেমিনার, কর্মশালা আয়োজনের জন্য রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ৫টি হলরুম।
পলাশবাড়ী উপজেলার হরিণমারী গ্রামে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে ড্রিমল্যান্ড এডুকেশনাল পার্ক। ১৯৯৫ সালে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রশিদুন্নবী চাঁদ প্রায় ১৭ একর জমিতে এই বিনোদন কেন্দ্রটি নির্মাণ করেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এ পার্কে রয়েছে দেশি-বিদেশি বৃক্ষ, ফুলের বাগান, ভাস্কর্য এবং বিভিন্ন স্থাপনা। আরও আছে ২৫৫ জন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ও গুণীজনদের ভাস্কর্য।
সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গায় রয়েছে জমিদার বাড়ি। উপমহাদেশখ্যাত নাট্যকার-শিল্পী, চলচ্চিত্র অভিনেতা তুলসী লাহিড়ীর স্মৃতি বিজড়িত নলডাঙ্গার জমিদার বাড়িতে এখনো রয়েছে বাসগৃহ, কুয়া, পুকুর ও মন্দির। গাইবান্ধা জেলার অতীত ইতিহাসের এক সুর্বণ স্বাক্ষর।
এছাড়া উপজেলার বড় জামালপুর গ্রামে অবস্থিত শাহী মসজিদ। লোকমুখে শোনা যায় ৯৩০ সালে পারস্য থেকে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসা হযরত শাহ জামাল (র.) এর হাতেই নির্মিত হয় এই ঐতিহাসিক মসজিদ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এলাকাবাসী মূল অবকাঠামো ঠিক রেখে মসজিদের সামনের অংশে বারান্দা নির্মাণ করে মসজিদের মেঝে সম্প্রসারণ করেছে। মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি মাজার। মাজারটি হযরত শাহ জামালের বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
গাইবান্ধা শহরের ঐতিহ্যবাহী রসমঞ্জরী বাংলার এক বিখ্যাত মিষ্টি। মিষ্টি প্রস্তুত করা হয় দুধ, ছানা ও ক্ষীর ও চিনির দ্বারা। মিষ্টিতে ব্যবহৃত ঘন রসের স্বাদের জন্য এই মিষ্টির নাম রসমঞ্জুরী। জেলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি এটি। দেখতে রসমালাইয়ের মতো হলেও প্রস্তুত প্রণালির কারণেই এর স্বাদ অনন্য।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলাধীন বর্ধনকুঠি তৎকালীন রাজা-বাদশাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ইউনিট ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে এখানে রাজা রামপাল বাসুদেব মন্দির নির্মাণ করেন। তখন রাজা মানসিংহ বাংলার সুবাদার ছিলেন। ইংরেজ আমলে তা জমিদার বাড়তি হিসেবে খ্যাতি পায়। বিধ্বস্ত রাজবাড়ির উন্মুক্ত অংশের বিভিন্ন রকমের সুসজ্জিত ছায়াঘন বৃক্ষ, ফাঁকে ফাঁকে শিল্পীর নিপুণ হস্তে গড়া এককালের দালানকোঠা আর তার অংশবিশেষে গড়ে ওঠা গোবিন্দগঞ্জ কলেজ আজও বর্ধনকুঠির স্মৃতিচিহ্ন বক্ষে ধারণ করে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এ ছাড়াও গাইবান্ধার দাড়িয়াপুরের মীরের বাগানের ঐতিহাসিক শাহসুলতান গাজীর মসজিদ, পলাশবাড়ীর প্রাচীনতম ছোট মসজিদ, ফাঁসিতলার মাস্তা মসজিদ ইতিহাসে উল্লিখযোগ্য। সেই সঙ্গে নদীবেষ্টিত এই গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা-করতোয়া নদীর বুকে জেগে উঠেছে প্রায় দেড় শতাধিক চর। এসব নদ-নদী ও চরাঞ্চলে ভ্রমণ করে থাকেন ভ্রমণপিপাসু মানুষ।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমান বলেন, এ জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
ঢাকা বিজনেস/এম