১৮ মে ২০২৫, রবিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

ভাগ্য গণনা

মো: রুহুল আমিন || ০৪ মে, ২০২৫, ০৪:০৫ পিএম
ভাগ্য গণনা


পেশার বয়স পঁইত্রিশ বছর পার হয়েছে। বয়স এখন চৌষট্টি/পঁইষট্টি। শরীর আর নড়ে না, কঙ্কালসার দেহটি শুয়ে আছে বিছানায়। চোখে ঝাপসা দেখে, কণ্ঠেও আগের তেজ নেই।

এক সময় গভীর আস্থা, নির্মল চেতনা, সরল বিশ্বাস, ছলচাতুরি, প্রতারণা কিংবা সহজ জীবিকার উপায় হিসেবে এ পেশা বেছে নিয়েছিলেন কদম আলী—ভাগ্য গণনা।

রাস্তার পাশে পিঁড়িতে বসেন তিনি, মাথার ওপর ছোট্ট সাইনবোর্ড: “টিয়া পাখি ভাগ্য বলে”, পাশে টিয়ার খাঁচা, আর হাতে একখানা সরু লাঠি।

চতুর ও বুদ্ধিমান টিয়া পাখি নাকি ভাগ্য বলে দিতে পারে—এই বিশ্বাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পদ্ধতি খুব সহজ। খাঁচার ওপর বসে থাকে টিয়া। কেউ ভাগ্য জানতে এলে কদম আলী আগে তার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেন, তারপর লাঠি বাড়িয়ে দেন টিয়ার দিকে। লাঠিতে ভর করে নেমে আসে পাখিটি। সামনে সাজানো ইনভেলপগুলোর মধ্যে ভাগ্য লেখা কাগজ থাকে। টিয়া হেঁটে বেড়িয়ে একটি ইনভেলপ ঠোঁটে তুলে আনে। এটাই তার অভ্যাস।

ধীরে ধীরে কদম আলী ইনভেলপ খুলে কাগজ বের করেন। আসলে এটি তার অভিনয়। এরপর গড়গড় করে ভাগ্য পড়ে শোনান:

“আপনার কপাল সুপ্রসন্ন, সব কাজে সফলতা আসবে, রাজকন্যা/রাজপুত্র অপেক্ষায় আছে, প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হবেন, ব্যবসায়ে উন্নতি হবে, চাকরি মিলবে অনায়াসে, সব বিপদ কেটে গেছে, মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বাড়বে। তবে হিংসুকদের থেকে সাবধান থাকতে হবে।”

এভাবে পুরুষ-মহিলা, নানা বয়সের লোক ভাগ্য জানতে আসতে থাকেন। একদিন একজন তরুণ, বয়স ২৩/২৪, হন্তদন্ত হয়ে এসে ভাগ্য জানতে চাইল। যথারীতি টিয়া ইনভেলপ তুলল। এবার কদম আলী পড়লেন:

“আপনার সামনে শনির দশা, ভালো পাত্রী জুটবে না, সংসার টিকবে না, ব্যবসায় লোকসান, ধনসম্পত্তি হারানোর আশঙ্কা, সামাজিক মর্যাদাও যাবে, রাস্তায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, এমনকি জীবননাশের আশঙ্কাও রয়েছে। সাবধান থাকুন।”

ভাগ্যের এমন নির্মম বয়ান শুনে সিটু মিয়ার মাথার রগ ছিঁড়ে গেল, ভীমরি খেয়ে পড়ে গেল। কিন্তু কদম আলীর মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, “বিশ টাকা দেন।”

এরপর আবার খদ্দের আসে। একই কৌশল, একই কায়দা। কারো ভাগ্যে ভালো, কারো খারাপ। এমনও হয়, কেউ একদিনে দু'বার আসে—প্রথমবার ভালো, দ্বিতীয়বার খারাপ। কদম আলীর উত্তর সরল:
“ভাগ্যে উষ্ঠা লাগছে, তাই উল্টে গেছে।”

অনিশ্চিত ও ভঙ্গুর জীবনে মানুষ শান্তি ও নিশ্চয়তা চায়, ভবিষ্যৎ জানতে চায়—এ সুযোগেই জমে উঠেছে কদমের ব্যবসা।

তবে অদ্ভুতভাবে কদম আলী কখনো নিজের বা স্ত্রী-সন্তানদের ভাগ্য জানার চেষ্টা করেননি। স্ত্রী গত হয়েছেন ১০/১২ বছর। বাতাসে অবশ হয়ে কয়েক বছর অসহায়ভাবে কাটিয়েছিলেন। একদিন চলে গেলেন।

তিন মেয়ে, এক ছেলে। উপার্জনে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। মেঝো মেয়ে স্বামীর হাতে নির্যাতিত। ছোট মেয়ে হঠাৎ একদিন আবোল-তাবোল বকতে শুরু করে, এখন সে পুরো উন্মাদ।

ছেলেটি, কামরুল, কখনোই পিতার পেশাকে পছন্দ করেনি। তার কাছে এটা প্রতারণা। সে অন্যত্র বিয়ে করে আলাদা সংসার করেছে।

এখন শূন্য ঘরে কদম আর তার টিয়া পাখি। দেহ অচলপ্রায়, চোখে দেখে না, শ্বাসকষ্ট, গাঁটে গাঁটে ব্যথা। টাকা কিছু আছে, কিন্তু দেখভালের কেউ নেই। খাবারের অভাব, এমনকি টিয়া পাখিটাও কাহিল।

হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করা কদম আলী জানতেই পারেননি নিজের পরিণতি।

এক দুপুরে দরজার কপাট শব্দ করে খুলে গেল। অনেকদিন পর সেই ঘরে ঢুকল একজন মানুষ—মাঝবয়সী, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, মুখে দাড়ি, চোখে বুদ্ধির দীপ্তি। এসে বসে পড়ল কদম আলীর শিয়রের পাশে।

কদম চোখ মেলে তাকালেন। একটু সময় লাগল চিনতে। তারপর বুঝলেন—এ যে তার ছেলে, কামরুল।

কামরুল বাবার হাত ধরল, বলল, “বাবা, আমি ফিরেছি। সব ছেড়ে দিয়েছি। এবার তোমার পাশে থাকব।”

কদম কিছু বললেন না, শুধু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

সেই রাতেই শরীরটা বেশি খারাপ হয়ে গেল। ডাক্তার এলো, ওষুধ এল, পরিচর্যা চলল। কিন্তু ভোররাতে, কুয়াশার ভেতর দিয়ে নিঃশব্দ যাত্রায় কদম আলী পাড়ি জমালেন অজানার পথে।

সেদিন টিয়া পাখিটা খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে এলো। কামরুল সেটাকে জানালার ধারে বসিয়ে দিল।

পরদিন রাস্তার পাশে সেই পুরনো পিঁড়ি বিছানো ছিল। তবে সাইনবোর্ড বদলে গেছে:

“ভাগ্য নয়, চেষ্টা বলেই জীবন চলে। চা খেতে বসুন, গল্প করুন। মনে চাইলে বই পড়ুন।”

টিয়া এখন জানালার ধারে বসে থাকে। কামরুল নিজ হাতে চা বানান, মানুষের গল্প শোনেন, বাবার কথা বলেন। পিঁড়ির পাশে রাখা কিছু বই। আর একটি ছোট বোর্ডে লেখা—

“বাবা বলতেন, ভাগ্য কাগজে লেখা যায়,
কিন্তু জীবন লেখা যায় ভালোবাসায়, মানুষের সেবায়।”

এভাবেই কদম আলীর গল্প শেষ হয় না—তিনি রয়ে যান তাঁর ছেলের নতুন পথের ভিতর, কিছু মানুষের নতুন আশার সূচনায়।

লেখকঃ  সাবেক পরিচালক ,  ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর



আরো পড়ুন