জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন শাখায় অসামান্য অবদান রাখায় বিশ্বের শীর্ষ ১০ ব্যক্তিত্বের তালিকা প্রকাশ করেছেন খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’। এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ড. ইউনূসের বিষয়ে নেচারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বৈরাচারী সরকারের পতনে যারা বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের একটাই দাবি ছিল—নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেশের নেতৃত্ব দিতে আমন্ত্রণ জানানো হোক। এছাড়া নেচারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘নেশন বিল্ডার’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
নেচারের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেচারের শীর্ষ ১০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় গত এক বছরে বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা লোকদের বাছাই করেছে। এই তালিকা করেছেন নেচারের সম্পাদক। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে কীভাবে গবেষকেরা আমাদের পৃথিবীকে গড়ছেন তার স্বীকৃতি এই তালিকা। এ বছরের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো হলো—আবহাওয়া পূর্বাভাসের নতুন ধারণা থেকে শুরু করে একটি জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি।
ছয় দশকের পেশাগত জীবনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য নতুন ধারণা পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সিস্টেম বুঝে সমস্যার সমাধান করা ইউনূসের কাজের মূল ভিত্তি। ড. ইউনূসের সঙ্গে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন অ্যালেক্স কাউন্টস। তিনি ড. ইউনূস সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি আশির কোঠায়, কিন্তু তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উজ্জ্বল। তার সহানুভূতি রয়েছে এবং তিনি একজন চমৎকার যোগাযোগকারী।
বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া ড. ইউনূস ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং পরিবেশগত অর্থনীতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নিকোলাস জর্জেসকু-রোগেনের অধীনে পড়াশোনা করেন। সে সময়ই তার মধ্যে অর্থনীতি ও প্রকৃতির মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে স্পষ্ট বোঝাপড়ার সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর তিনি দ্রুত দেশে ফিরে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন দেশ গঠনে অংশীদার হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন।
ড. ইউনূসের সবচেয়ে আলোচিত উদ্ভাবন হলো ‘মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্র ঋণ’, যার পরিমাণ প্রায়শই ১০০ ডলার বা তার চেয়ে কম হয়ে থাকে। ড. ইউনূস দেখিয়েছেন যে সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে, ক্ষুদ্রঋণ সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র অংশের জীবন বদলে দিতে পারে।
ড. ইউনূস ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালে পরীক্ষা করতে শুরু করেন যে, ক্ষুদ্রঋণ কীভাবে ফেরত পাওয়া যায় এবং ঋণগ্রহীতারা কীভাবে এটি থেকে লাভবান হতে পারে। এরপর তিনি একটি মডেল তৈরি করেন, যেখানে নারীদের ঋণ দেওয়া হতো তাদের ব্যবসা উন্নত করার জন্য। প্রথম পরীক্ষায় সব ঋণগ্রহীতাই তাদের ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হন। ১৯৮৩ সালে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তার ক্ষুদ্রঋণের ধারণা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। তবে অনেকে এর সমালোচনাও করেন।
তবে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা এবং ১৭ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ পরিচালনার মধ্যে ফারাক রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সবাই প্রশ্ন করছেন, ড. ইউনূস কি সত্যিই ছাত্রদের দাবির প্রতি যে প্রতিশ্রুতি তা রক্ষা করতে পারবেন? এসব দাবির মধ্যে—দুর্নীতি নির্মূল, নাগরিক অধিকার রক্ষা এবং শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সমতা প্রদান এবং যারা প্রতিবাদে নিহত হয়েছেনতাদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ মুশফিক মোবারক বলেন, ‘আগস্টের বিপ্লবের আগে দেশের পুলিশ, নাগরিক সেবা, বিচারব্যবস্থাসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি ব্যাংকগুলোও শাসক দলের শাখা হয়ে উঠেছিল। ইউনূস এবং ছাত্ররা—যারা অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভায় সদস্য হিসেবে আছেন—বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গ্রুপ তৈরি করেছেন, যাতে যে দলই ক্ষমতায় থাক না কেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা পায়।’
কুমিল্লার বাংলাদেশ একাডেমি অব রুরাল ডেভেলপমেন্টের (বার্ড) গবেষণা পরিচালক ফৌজিয়া সুলতানা বলেন, ‘কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার তাড়াতাড়ি হতে পারে না। এটি একটি জটিল ও ধীরগতির প্রক্রিয়া।
অন্তর্বর্তী নেতা হিসেবে ড. ইউনূসের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করবে সেই সব ছাত্রের ওপর, যারা তাকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিলেন। তারা একটি শক্তিশালী দল, যাদের ভূমিকা ২০১০-২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামকারী যুবকদের মতো। সেই বিদ্রোহ সহিংসভাবে দমন করা হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের গল্পটি ভিন্ন।
সেনাবাহিনী এবং ইউনূস উভয়েই ছাত্রদের সমর্থন করছেন। তবে এর মানে হলো—একটি বড় দায়িত্ব এক ব্যক্তির ওপর অর্পিত, যাকে অধিকার রক্ষা এবং সেই সব সুযোগ তৈরি করার প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে, যেগুলো ছাত্রদের অনেক বন্ধু ও সহকর্মী জীবিত থাকতে দেখতে পাননি।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের সময় তার সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে আট শতাধিক মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হয়। এরপর ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে অবশেষে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান।